রাজনীতির দায়েই ফের ক্ষতিপূরণ
সারদার স্কিমে টাকা রেখে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সাহায্যের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার মহাকরণে তিনি বলেন, “আমানতকারীদের মধ্যে অনেকেই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। তাঁদের সাহায্যের জন্য আমরা ৫০০ কোটি টাকার ত্রাণ তহবিল তৈরি করেছি। তবে এই সাহায্য করা হবে সরকারের তৈরি উচ্চ পর্যায়ের কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে।”
সারদা কেলেঙ্কারির প্রথম দিন থেকেই লক্ষ লক্ষ আমানতকারী তাকিয়ে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূল নেতৃত্বের দিকে। শুক্রবার মমতার কালীঘাটের বাড়ির সামনের রাস্তায় বসেও পড়েন বেশ কিছু মানুষ। পরে ভিড় করেন তৃণমূলের সদর কার্যালয়ে। অথচ এ নিয়ে বলতে গিয়ে সোমবার মমতা বলেন, ‘যা গেছে তা গেছে।’ যে কথা শুনে আশাহত হয়েছিলেন কম সময়ে বেশি টাকা পাওয়ার লোভে সর্বস্বান্ত মানুষেরা।
এর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ১৮০ ডিগ্রি বদলে গেল মমতার বক্তব্য। এখন তিনি এক দিকে বাজেয়াপ্ত করা সারদার সম্পত্তি থেকে টাকা সংগ্রহের কথা বলেছেন (তদন্তকারী থেকে প্রশাসনের অফিসার অনেকেরই বক্তব্য, এ ভাবে টাকা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব)। অন্য দিকে, সরকারের তরফে বিশেষ তহবিল গঠনের কথাও ঘোষণা করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই পরিবর্তন?
অনেকেই বলছেন, এর পিছনে রাজনৈতিক কারণই বড়। সোমবার মমতা ‘যা গেছে তা গেছে’ বলার পরে বিরোধীরা কঠোর সমালোচনা শুরু করেন। সিপিএম এবং কংগ্রেস, দু’পক্ষেরই বক্তব্য ছিল, কেলেঙ্কারির সঙ্গে শাসকদলের নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। মমতা তাই দায় এড়াতে পারেন না। যেখানে মানুষ তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল, সেখানে এই কথা বলে তাদের তিনি খাদের দিকেই ঠেলে দিয়েছেন।
সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার মহাকরণে। ছবি: সুদীপ আচার্য
তৃণমূল নেতৃত্বও বুঝতে পারছিলেন, সারদা কেলেঙ্কারি গ্রামাঞ্চলে দলের ভোটব্যাঙ্কে ছাপ ফেলতে বাধ্য। তা থেকে বাঁচতে কিছু করা দরকার। সেই তাগিদ থেকেই এ দিনের ৫০০ কোটি তহবিল গঠনের ঘোষণা বলে মনে করছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন, ত্রাণ তহবিল গঠন ছাড়া মমতার কিছু করারও ছিল না।
কিন্তু আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত (যে কথা মমতা বারবার বলেন, এ দিনও বলেছেন) রাজ্য সরকার এই টাকা দেবে কোথা থেকে?
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমরা সিগারেটের উপরে ১০% কর বাড়াব। অন্য রাজ্যে তামাকের উপরে ৪০ থেকে ৫০% কর নেওয়া হয়। সেখানে আমাদের রাজ্যে সেই করের পরিমাণ ২৫%। এই কর বাড়ালে আমাদের হাতে ১৫০ কোটি টাকা আসবে।” বাকি টাকার বেলায় অবশ্য ধোঁয়াশা রেখেছেন তিনি: “বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে, তা এখনই বলছি না। তবে জনগণের উপরে যাতে চাপ না পড়ে, সেটা আমরা দেখব।”
এই তহবিল গঠন নিয়ে অর্থনীতিবিদরা কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত। এক পক্ষ মনে করেন, সরকার তার দায়বদ্ধতা এড়াতে পারে না। কিন্তু আর একটি পক্ষের বক্তব্য, রাজ্যের দায়িত্ব শুধু একটা বিষয়ই দেখা একেবারে না খেতে পেয়ে যেন কেউ না মরে। তা ছাড়া ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা ভুল হবে।
কেউ কেউ এ-ও বলছেন, যেখানে লোভে সর্বস্বান্ত হয়েছেন মানুষ, সেখানে তাঁদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করাটা কি যুক্তিযুক্ত? এর পরে তো এই লোকেরা আবার একই কাজ করবে। সরকার কত বার ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের বাঁচাবে?
ক্ষতিপূরণ ঘোষণার ট্র্যাডিশন এই সরকারের প্রথম থেকেই। বিষমদে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন। যদিও দেড় বছর পরেও সেই টাকা পাননি মৃতদের পরিজনেরা। এ দিন সে ভাবেই ত্রাণের কথা মমতার মুখে এসেছে বলে দাবি বিরোধী পক্ষের অনেকের। বিস্তারিত মন্তব্য না করলেও বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বুঝিয়ে দিয়েছেন, এমন সিদ্ধান্ত তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, “প্রতারকদের আড়াল করব, আবার প্রতারিতদের পাশে দাঁড়াব এই দু’টো একসঙ্গে হয় না! মুখ্যমন্ত্রী সেটাই করতে চাইছেন!” সারদা গোষ্ঠীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য আদালতে যাওয়া-সহ সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া শুরু না-করে সরকার কেন ত্রাণ তহবিল খুলতে যাচ্ছে, তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সিপিএম। সেলিম আবার বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সুদীপ্ত সেন উত্তরে আছেন। তিনি উত্তর থেকেই ধরা পড়েছেন। এ বার মুখ্যমন্ত্রীকে অনেক উত্তর দিতে হবে!” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের আরও কটাক্ষ, “এ সবই তো মাছের তেলে মাছ ভাজা! সারদার টাকায় শাসক দল পঞ্চায়েতে লড়বে। আবার তাদের কাছ থেকে ভাগ পাওয়া টাকাতেই তহবিল খুলে প্রতারিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দেওয়া হচ্ছে!”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের অবশ্য বক্তব্য, “আমানতকারীরা এক বার প্রতারিত হয়েছেন। সরকার যে টাকা দেবে বলেছে, কোনও পদ্ধতিগত কারণে তাঁরা যেন তা থেকে আবার বঞ্চিত না হন।” প্রদীপবাবুর মতে, যা ক্ষতি হয়েছে, ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে তা মেটানো সম্ভব নয়। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পরামর্শ, সমস্যা এড়াতে একটা কমিশন হোক। যারা আইনি পথে ক্ষতিপূরণের পুরো প্রক্রিয়াটি দেখভাল করবে।
মমতা অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, সদ্য গঠিত কমিশনই পুরো প্রক্রিয়াটি দেখবে। তিনি এ দিন জানান, “সরকার প্রশাসনিক এবং আর্থিক, সব দিক দিয়েই কমিশনের কাজে সাহায্য করবে। খুব শীঘ্রই কমিশন কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে। সেই বিজ্ঞাপন দেখে অভিযোগ জানাবেন। কমিশন জানার চেষ্টা করবে, এই সব সংস্থায় কারা, কত টাকা রেখেছিলেন। আপনারা সেই তথ্যের দু’টো করে প্রতিলিপি নিয়ে যাবেন। একটি কমিশন গ্রহণ করে অন্যটি সই করে ফেরত দিয়ে দেবে।”
মহাকরণের খবর, চার সদস্যের কমিশনে শ্যামল সেন ছাড়াও থাকছেন সদস্য-সচিব মিহির ভট্টাচার্য (আইজি-দক্ষিণবঙ্গ), অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার যোগেশ চট্টোপাধ্যায় এবং পশ্চিমবঙ্গ অর্থ নিগমের চেয়ারম্যান অম্লান বসু। কমিশনকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “প্রয়োজনে উত্তরবঙ্গে এবং দক্ষিণবঙ্গেও কমিশন অফিস খুলতে পারে। সেটাতেও সরকার সাহায্য করবে।” তবে মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, “এই কাণ্ডে সরকার কোনও ভাবেই যুক্ত নয়। পুরোটাই বেসরকারি।” একই সঙ্গে বলেন, “একজন সাংবাদিক, একটি কাগজ, একটি চ্যানেলকে চিহ্নিত করে লাভ নেই। তৃণমূলের কোনও সাংসদ যদি অন্যায় করেন, তবে আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। কিন্তু সিপিএমের হয়ে যারা এখন কথা বলছে, সেই চ্যানেলের পদাধিকারীদেরও নাম বেরিয়ে আসবে।”
সারদা কাণ্ডের তদন্তে পুলিশ ভাল কাজ করেছে বলে তাদের সাধুবাদ দেন মমতা। পাশাপাশি জানান, ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণে আইন করতে বিধানসভায় বিল আনা হবে। তিনি বলেন, “২৯ এপ্রিল থেকে ৬ মে-র মধ্যে ওই বিল পাশ করব।” সিপিএম-কে তাঁর কটাক্ষ, “তামিলনাড়ুতে ১৫ বছর আগে আইন করলেও আপনারা করলেন না কেন!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.