ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে নতুন আইন আনতে ২৯ ও ৩০ এপ্রিল বিধানসভার অধিবেশন ডাকা হল। পরিষদীয় দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই দিনই ২০০৯ সালে পাশ হওয়া বিলটি প্রত্যাহার করে নতুন বিল পেশ করা হবে। পরিষদীয়মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষাই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। নতুন আইনে সেই ব্যবস্থা রাখা হবে। আইনটি যাতে দ্রুত রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করেন, সে ব্যাপারেও উদ্যোগী হবে সরকার। বাম আমলের বিলটি ফেরত পাঠানোর জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে আগেই অনুরোধ করেছিল রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী আজ জানিয়েছেন, সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার অনেক আগেই ৮ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রের কাছ থেকে ওই বিল ফেরত চাওয়ার জন্য রাজ্যপালকে চিঠি পাঠিয়েছিল তাঁর সরকার। নতুন কিছু সংশোধনের প্রস্তাব করে অবশেষে সেটি ফেরত পাঠাচ্ছে কেন্দ্র। সেই সব প্রস্তাবের অন্যতম হল, সঞ্চয়কারীদের অর্থ ফেরত দিতে শুধু প্রতারক সংস্থা ও তার কর্ণধার বা কর্মচারীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলেই চলবে না। সংস্থা বা তার মালিকের তরফে অন্য কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার নামে সম্পত্তি হস্তান্তর করা হলে, কিংবা ঋণ দেওয়া হলে তাদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করতে হবে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের স্বার্থ সুরক্ষা রাখাই সরকারের অগ্রাধিকার। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সর্বশেষ পাশ হওয়া বিলে বলা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রোমোটার, অংশীদার, ডিরেক্টর, ম্যানেজার, সদস্য, কর্মীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হলে আইন আরও কড়া করা দরকার। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে, এই সব প্রতারক সংস্থা নিজেদের নামে সম্পত্তি না-রেখে অন্য কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার নামে সম্পত্তি হস্তান্তর করে দেয়, বা বেনামে বিনিয়োগ করে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থাকে ঋণও দেওয়া হয়। তাই কেন্দ্রের প্রস্তাব সঞ্চয়কারীদের অর্থ ফেরত দিতে ওই সব সংস্থা বা ব্যক্তির সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হোক। মূলত এই সংশোধনের প্রস্তাব ছাড়াও আমানতকারীদের অর্থ দ্রুত আনুপাতিক হারে ফেরত দেওয়ার জন্য কিছু প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনের সুপারিশ রাজ্যকে পাঠানো হবে।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের এক শীর্ষ আমলা জানান, তামিলনাড়ু ও কর্নাটকে এই ধরনের কঠোর আইন ইতিমধ্যেই রয়েছে। কেন্দ্র চাইছে ভুঁইফোঁড় অর্থসংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য সব রাজ্যের আইনের মধ্যে যেন সামঞ্জস্য থাকে। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে পুরনো বিলে সংশোধনের জন্য সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। ওই আমলার কথায়, কেন্দ্রের প্রস্তাবমতো রাজ্য সরকার পুরনো আইনে সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠালে দ্রুত অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হবে। রাজ্যের অর্থ দফতরের পুরনো, অভিজ্ঞ অফিসারেরা অবশ্য বলছেন, ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থার টাকায় বেনামে সম্পত্তি কেনার বিষয়টি নিয়ে বাম আমলে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন অফ ইন্টারেস্ট অফ ডিপোজিটর্স ইন ফিনান্সিয়াল এস্ট্যাবলিশমেন্টস বিল ২০০৯’-এর ১৩ নম্বর ধারার ব্যাখ্যায় এবং ১৪ নম্বর ধারার ১ ও ২ উপধারায় বেনামি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি পরিষ্কার করে দেওয়া আছে।
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রণে কড়া আইন করার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গত রবিবার মুখ্যমন্ত্রীর কথা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে আটকে থাকা বিলটির ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার করেন মমতা। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ফেরত পাঠালে প্রয়োজনে রাজ্য অর্ডিন্যান্স জারি করে কঠোর আইন বলবৎ করবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য প্রক্রিয়াগত দিকটি বিবেচনা করে বিধানসভার জরুরি অধিবেশন ডাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরে রাষ্ট্রপতি প্রথমে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে কথা বলেন। তার পর গত কাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়। শিন্দেকে প্রণববাবু জানান, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি স্পর্শকাতর। লক্ষ লক্ষ মানুষ অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তাই বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে সংশোধনের প্রস্তাবগুলি দিয়ে পুরনো বিলটি রাজ্যকে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। সূত্রের খবর, সম্ভবত এ সপ্তাহের মধ্যেই রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে পাঠিয়ে দেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় আজ বলেন, কেন্দ্র বিলটি ফেরত পাঠালেই নতুন বিল পাশ করাতে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করবে না রাজ্য সরকার। তবে পুরনো বিলটিতে কী কী পরিবর্তন তাঁরা আনতে চাইছেন, তা স্পষ্ট করে বলেননি তিনি। পার্থবাবুর কথায়, “যথাসময়েই সব জানানো হবে।” সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, আসলে সংশোধনের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রের ঘরোয়া আলোচনা ও বোঝাপড়া হয়েছে। তার পরই সংশোধনী প্রস্তাব-সহ পুরনো বিলটি পাঠাতে তৎপর হয়েছে কেন্দ্র। তবে রাজ্য সরকার ২০০৯ সালে বিল পাশ করে পাঠানোর পরে কেন্দ্র এত দিন কেন চুপচাপ বসেছিল, সেই প্রশ্ন উঠছে। এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট কোনও জবাব অবশ্য কেন্দ্রের কর্তারাও দিচ্ছেন না। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০০৯ সালের ২২ ডিসেম্বর বিল পাশ হওয়ার পরে রাজ্যপালের মাধ্যমে সেটি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে আসে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সেটি অর্থ মন্ত্রকের কাছে পাঠায় ২০১১ সালের মার্চ মাসে, অর্থাৎ দু’বছর পর। তখন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। মন্ত্রকের নীচুস্তরের আমলারা এর পর বিলটি নিয়ে এক বছর বসে ছিলেন। অর্থমন্ত্রীর কাছে বিলটি পাঠানো হয় ২০১২ সালের মার্চ মাস নাগাদ। কিন্তু তত দিনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক তৎপরতা তুঙ্গে উঠেছে। বিলটি নিয়ে আর অগ্রগতি হয়নি।
কিন্তু এখন সারদা-কাণ্ড নিয়ে বিতর্ক যে মাত্রায় পৌঁছেছে এবং তাতে আইনের প্রশ্নটি যে পরিমাণ গুরুত্ব পাচ্ছে, তাতে পুরনো বিলটি ফেরত পাঠাতে আরও দেরি হলে কেন্দ্র যে সমালোচনার মুখে পড়বে তা বুঝতে পারছে কংগ্রেস। আর সেই কারণেই রাজ্যকে ‘সাহায্য করতে’ সক্রিয় হয়ে উঠেছে মনমোহন সিংহের সরকার। |