সারদা-কাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছেন তৃণমূলের নেতা-সাংসদের অনেকে। সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত তৃণমূলের সাংসদ কুণাল ঘোষকে এখনই দল থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য শুভেন্দু অধিকারী, দীনেশ ত্রিবেদীর মতো অনেক সাংসদই নেতৃত্বের কাছে দাবি তুলেছেন। দিল্লি থেকে ফিরে বুধবার শুভেন্দু বলেন, “সারদা গোষ্ঠী গরিব মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সেই গোষ্ঠীর সঙ্গে কুণাল ঘোষ বা দলের যে সমস্ত নেতার নাম জড়িয়েছে, তাঁদের সবাইকে দল থেকে সরানো উচিত। এঁদের জন্য দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।”
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে এ দিন এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের টাকা কী ভাবে ফেরত দেওয়া যায়, আগে তার ব্যবস্থা দরকার। সেটা সরকার দেখছে। আর দোষীদের বিষয়ে আইন আইনের পথে চলবে।” মুকুলবাবু খোলসা না করলেও নেতৃত্বের বড় অংশই চান, নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করুন। এ দিন সিবিআই-কে লেখা সুদীপ্ত সেনের চিঠি সংবাদমাধ্যমের হাতে চলে আসায় এবং চিঠিতে কুণাল-সহ কয়েক জন সাংসদের নাম প্রকাশ্যে আসায় তৃণমূল নেতৃত্ব বেশ বিব্রত। আসন্ন পঞ্চায়েত ও আগামী লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে শুভেন্দুর মতো দলের সাংসদ-নেতাদের অনেকেই বলছেন, “দুই রাজ্যসভা সদস্যকে তো আর ভোটে দাঁড়াতে হবে না। এক বছর পরে আমাদেরই মানুষের কাছে ভোট চাইতে হবে। তখন তো তাঁরা আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না।” কুণালের অবশ্য দাবি, ওই গোষ্ঠীতে তাঁর ভূমিকা ছিল শুধুই সাংবাদিকের। |
এই পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত ভোটের আগে দ্রুত দলের ভাবমূর্তি ফেরাতে চেষ্টা শুরু হয়েছে তৃণমূলে। ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার রমরমা যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই শুরু হয়েছে, তা মানুষকে জানাতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচারও শুরু করেছে তৃণমূলের যুব সংগঠন। দলের ওয়েবসাইটে ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থা বলতে কী বোঝায় এবং কী ভাবে রাজ্যে বাম আমলে ও দিল্লিতে কংগ্রেসের মদতে ওই সংস্থাগুলির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, তার প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু সর্বস্ব হারানো প্রতারিত মানুষগুলির কাছে ওই বার্তা কতটা ভরসা দেবে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন দলের নেতারা।
ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দহরম মহরম, বা তৃণমূল নেতাদের দেখে যে সাধারণ মানুষ লগ্নি করেছিলেন সেই সত্যটি এখন ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছেন দলীয় নেতারা। ফলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে দলকে। এই অবস্থায় দলের আশু লক্ষ্য হল যে ভাবেই হোক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। সেই উদ্দেশ্যে তৃণমূল শিবির এখন গোটা কাণ্ডটির জন্য সিপিএম নেতৃত্বকে দায়ী করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি যে মৃত্যুফাঁদ তৈরি করেছে, তার জন্য ইতিমধ্যেই গৌতম দেব, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দায়ী করেছিলেন মুকুলবাবু। দলের পক্ষেও ওয়েবসাইটে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এখন সিপিএম নেতৃত্ব সরব হলেও কেন বাম আমলে ওই সংস্থাগুলিকে বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। রাজ্যবাসীর স্বার্থ রক্ষায় ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিলটি কেন প্রায় দশ বছর ধরে পড়ে রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে যুব তৃণমূল।
কেবল সিপিএমই নয়, তৃণমূল আঙুল তুলেছে ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধেও। দলের বক্তব্য, সারদা সংস্থা সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমেও বিপুল অর্থ লগ্নি করেছিল। তার জন্য কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় অনুমতি নেয় ওই সংস্থা। এ দিন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীও প্রশ্ন তুলেছেন, “সে সময়ে কেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক কোনও প্রশ্ন তোলেনি?” দলের এক নেতার কথায়, “সে সময়ে রাজ্যে সিপিএম ও দিল্লিতে কংগ্রেসের সরকার ছিল। দুই দল তখন সব জেনেও চুপ ছিল। এখন রাজনৈতিক ফায়দা নিতে তারা সরব হচ্ছে।”
কিন্তু জনরোষ যে মাত্রা নিয়েছে, এই পরিস্থিতিতে নেট-প্রচারে বা মহাকরণে দাঁড়িয়ে বাম-কংগ্রেসের দিকে তোপের মুখ ঘুরিয়ে নিজেদের বিড়ম্বনা কতটা এড়ানো যাবে, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তৃণমূল নেতাদেরই অনেকে। |