লগ্নি টেনে ক্ষোভের নিশানা তৃণমূল নেতারাই
লকাতায় তৃণমূলের সদর দফতরই হোক বা জেলায় মন্ত্রীর বাড়ির সামনে জমায়েত-বিক্ষোভ, শনিবার সব জায়গা থেকে একটাই কথা উঠে এসেছে। সেটা হল, এত দিন শাসকদলের যে সব নেতা সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে দহরম মহরম রেখে চলতেন, যাঁদের দেখে মানুষ এজেন্সি নিয়েছে এবং টাকা লগ্নি করেছে, আজ তাঁরা কোথায় গেলেন?
এই দাবিতে গোটা রাজ্যে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে এসে লেগেছে বিক্ষোভের ঢেউ। হতাশা এবং আতঙ্ক ছাপিয়ে বেরিয়ে এসেছে ক্ষোভ। কলকাতায় তৃণমূলের সদর দফতরের সামনে হাজির এজেন্টদের অনেকেই জানিয়ে গিয়েছেন, “রবিবার রাত পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে কোনও আশ্বাস না পেলে সোমবার বেলা ১২টায় মহাকরণ অভিযান করব।” যা দেখেশুনে সিপিএম নেতা গৌতম দেব বলেছেন, “এ রাজ্যে সবচেয়ে বড় চিট ফান্ড সংস্থার নাম তৃণমূল কংগ্রেস। চিট ফান্ড ও মমতা একাকার হয়ে গিয়েছে। তিনি নিজে জড়িত।” এর জবাবে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেছেন, “গৌতমবাবু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং ইউপিএ-১ সরকারের যোগসাজশেই রাজ্যে এই মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে।”
রাজ্য জুড়ে সারদার গ্রাহক ও এজেন্টদের ক্ষোভের সামনে অবশ্য মুকুলবাবুর এই আত্মরক্ষার যুক্তি হালে পানি পায়নি। বিশেষ করে যে ভাবে দিকে দিকে তৃণমূলের নেতারা সারদার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন, তাতে তাঁদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হতোই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।
যেমন, নিউ ব্যারাকপুরের তৃণমূল পুরপ্রধান নির্মিকা বাগচি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সারদা গ্রুপে এজেন্ট হিসেবে ৬০ লক্ষ টাকারও বেশি তুলেছেন তিনি। পুরপ্রধান হওয়ার পরে তিনি বিভিন্ন প্রোমোটারকে দিয়ে ওই সংস্থায় লগ্নিও করিয়েছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, ওই প্রোমোটারদের আবার পাল্টা নানা সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন পুরপ্রধান। নির্মিকাদেবী অবশ্য এ কথা অস্বীকার করে বলেছেন, “সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই।”
বিপন্ন ভবিষ্যৎ। আমানতকারীদের তালিকা হাতে ই এম বাইপাসে
তৃণমূল ভবনের সামনে এক এজেন্ট। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র
একই অভিযোগ শিলিগুড়ি পুরসভার কাউন্সিলর রঞ্জন শীলশর্মার বিরুদ্ধেও। এ দিন সেবক রোডে সারদা গোষ্ঠীর অফিসের সামনে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন এজেন্ট ও আমানতকারীরা। অনেককে চেঁচিয়ে বলতে শোনা যায়, “টাকা জমা রাখার আগে এলাকার অনেক তৃণমূল নেতার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ওঁরা সারদা গ্রুপ পালাবে না বলে ভরসা দিয়েছিলেন। এখন নেতারা আমাদের দেখুন।” বিক্ষোভে ছিলেন রঞ্জনবাবুর নিজের এলাকা ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারাও। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁদের বলতে শোনা যায়, “আমরা কাউন্সিলরের সঙ্গে পরামর্শ করেই অনেক কাজ করি। এ ক্ষেত্রেও আগে কথা বলেছিলাম। তার পরেও বিপদে পড়তে হল।” রঞ্জনবাবু অবশ্য বলেন, “আমি বিনিয়োগের ব্যাপারে কাউকে পরামর্শ দিইনি। কেউ মিথ্যে রটালে হবে না। প্রকাশ্যে এসে আমার নাম করে বলতে হবে।”
শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের সামনেও বিক্ষোভ হয় এ দিন। পাহারার জন্য বাড়তি পুলিশও মোতায়েন করা হয়। পরে অবশ্য মন্ত্রী গৌতম দেব পুলিশ সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। বালুরঘাটে নেপালিপাড়া এলাকায় তৃণমূলের ট্যাক্সি ইউনিয়নের এক সদস্য তথা গোষ্ঠীর এজেন্টের বাড়িতে গ্রাহকেরা বিক্ষোভ দেখান।
ঘাটালে আলমগঞ্জে শহর তৃণমূল নেতা অলোক দে-র বাড়ির দোতলাতেই চলত সারদা গোষ্ঠীর অফিস। একই বাড়িতে রয়েছে তৃণমূলের ঘাটাল ব্লক অফিস কার্যালয়ও। ওই অফিসের এক কর্মীর কথায়, “ঘাটাল অফিস থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যবসা হয়েছে।” সাধারণ মানুষের অভিযোগ, শাসকদল তৃণমূলের ইন্ধন না থাকলে এত অল্প সময়ে এত টাকার ব্যবসা করতে পারত না সারদা গোষ্ঠী, বিশেষত যেখানে এমন আরও অনেক সংস্থা রয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, ওই সংস্থায় এলাকার বেকার যুবকরা ছাড়াও তৃণমূলের একাধিক কর্মী-নেতৃত্ব যুক্ত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “মহকুমায় দলের কর্মসূচি থাকলে সারদা গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকা আদায় করা হত।”
অনেকেই বলছেন, এই ঘটনাগুলি থেকেই স্পষ্ট, কী ভাবে সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন তৃণমূলের নেতারা। এজেন্টরা তো বটেই, গ্রাহকরাও তাই মনে করেছিলেন, সারদার স্কিমে টাকা রাখলে তা মার যাবে না। শেষে যখন তাসের ঘর ভেঙে পড়ল, তখনই বিক্ষোভ আছড়ে পড়ল তৃণমূলের দফতরের সামনে।
এই ঘটনা শুধু রাজ্যেই নয়। কলকাতায় তৃণমূলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে এ দিন হাজির ছিলেন অসমের গুয়াহাটি ও ধুবুড়ি থেকে আসা এজেন্টরাও। ধুবুড়ির বাসিন্দা আব্দুল কাদের শেখ, রহমান খানেদের কথায়, “এ রাজ্যের একাধিক সাংসদ, নেতা ও মন্ত্রী তো সারদার পাশে ছিলেন। সে কথা ফলাও করে বলা হত।
সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট বলেই আমরা ভরসা পেয়েছিলাম।” এখন আমানতকারীদের তাগাদার ভয়ে সাত দিন ধরে পড়ে আছেন কলকাতায়।
একই কথা বারুইপুরে চৈতালি বন্দ্যোপাধ্যায়, মগরাহাটের রহিম ঢালি ও ঢাকুরিয়ার মমতা মণ্ডলদের। কেউ কেউ সারদা গোষ্ঠীর মালিকের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের যোগসাজশ নিয়ে সরব হন। বেহালার এক মহিলা এজেন্ট হঠাৎই চিৎকার করে বলেন, “শুরুতে ওদের ব্যবসা বাড়তে দিয়েছে তৃণমূল। এখন টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে দলকেই।”
পর পর দু’দিন দলের সদর দফতরের সামনে এজেন্টদের জমায়েতে অস্বস্তিতে পড়েছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, “দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এখনই জমায়েত সরিয়ে দেওয়া দরকার।” কয়েকটি জায়গায় মান বাঁচাতে পাল্টা প্রচারেও নেমেছে দল। শনিবারই পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার প্রতারণার বিরুদ্ধে পথে নেমে শাসকদল ও তাদের বিভিন্ন গণসংগঠনগুলি প্রচার চালায়। সরকারের প্রতি আস্থা রাখার আবেদন জানিয়ে গ্রাহকদেরও ভাঙচুর না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তৃণমূল কর্মীরা বিভিন্ন সংস্থার অফিসে গিয়ে এজেন্টদেরও গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষা করতে অনুরোধ করা হয়।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.