আতঙ্ক-রোষের নানা ছবি সারদার অফিস ঘিরে
খনও সূর্য ওঠেনি। বহরমপুরে সারদা গোষ্ঠীর আঞ্চলিক অফিসের সামনে হাজির হল ৪০-৫০ জনের একটি দল। কারও হাতে লাঠি, কারও শাবল। অনেকে আবার স্রেফ খালি হাতে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শাবল দিয়ে শাটার ভেঙে অফিসে ঢুকে পড়ে তারা। নির্বিচারে চেয়ার-টেবিল, কাচ ও আসবাব ভাঙচুর করে, নথিপত্র ছড়িয়ে রীতিমতো তাণ্ডব শুরু করে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, ভাঙচুরের পর কম্পিউটর-সহ কিছু আসবাব নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। পরে বহরমপুর থানার আইসি মোহাইমেনুল হক বলেন, “কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। তবে পুলিশ নিজে থেকেই মামলা করছে। অফিসটি সিল করে দেওয়া হয়েছে।”
শুক্রবারের পরে শনিবারেও জেলায় জেলায় সারদার দফতরগুলির সামনে ক্ষোভ, কান্না, হতাশা আর আতঙ্কের ছবি। কোথাও রাস্তায় শুয়ে পড়া, চোখের জল, আত্মহত্যার হুমকি, বন্ধ অফিসের সামনে গলার শিরা ফুলিয়ে টাকা ফেরত চাওয়া। কোথাও ভাঙচুর, বিক্ষোভ, লুঠপাট, অবরোধ। ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থায় আমানতকারী আর এজেন্টদের বড় অংশের আতঙ্ক আর রোষ এ ভাবেই শনিবার দিনভর আছড়ে পড়ল বালুরঘাট থেকে বহরমপুর, শিলিগুড়ি থেকে ঘাটালে।
বহরমপুরের মতোই লুঠপাট, ভাঙচুর হয়েছে সারদা গোষ্ঠীর ঘাটাল শাখার দফতরেও। সেখানেও জনতা অফিসের একাধিক কম্পিউটার, ল্যাপটপ, আসবাব, নথিপত্র লুঠ করে বলে অভিযোগ। পুলিশ আসার আগেই সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। পুলিশকে ঘিরেও বিক্ষোভ দেখানো হয়। উত্তেজনা থাকায় বসানো হয় পুলিশ পিকেট। কাঁথিতে সারদা গোষ্ঠীর নির্মীয়মাণ বহুতলে হামলা চালানো হয়। ওই বহুতল চত্বরে থাকা একাধিক গাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। গাড়ির ইঞ্জিন, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, টায়ার-টিউব, এমনকী গাড়ির ট্যাঙ্ক থেকে তেল লুঠের ঘটনাও ঘটে। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। শুক্রবার রাতেও কাঁথি বাইপাসের ধারে সারদার অফিসে বিক্ষোভ এবং ভাঙচুর করা হয়। যে বাড়িতে ওই অফিসঘর, তার মালকিন নিবেদিতা মণ্ডল রাতেই কাঁথি থানায় অভিযোগ করেন। পুলিশ গিয়ে অফিসটি ‘সিল’ করে দেয়।
বঞ্চনা-বিক্ষোভের দিনলিপি

একটি ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাকে কেন্দ্র করে
দুই এলাকার মধ্যে গণ্ডগোল। বারাসতে ময়না
এসপি অফিসের কাছে।

সল্টলেকে সারদা গ্রুপের ভাড়া নেওয়া
একটি অফিস থেকে নথিপত্র সরানোর
মুখে এসে পড়ে পুলিশ।

লাটাগুড়িতে সারদা গোষ্ঠীর রিসর্টে পুলিশ।

হাওড়ার বাগনানে সারদা গ্রুপের বন্ধ অফিস।
এ দিন সকালে উত্তরবঙ্গে প্রথম গোলমালের সূত্রপাত বালুরঘাটে। শহরের যুবশ্রী মোড়ে সারদা গোষ্ঠীর জেলা অফিসের সামনে শুরু হয় বিক্ষোভ। অফিস বন্ধ দেখে আত্মহত্যার হুমকি দেন আমানতকারীরা। পুলিশ বহু চেষ্টায় পরিস্থিতি সামাল দেয়। দুপুর ২টো থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত শিলিগুড়িতে সারদা গোষ্ঠীর অফিসের সামনে সেবক রোডে অবরোধ করে রাখেন সংস্থার এজেন্ট ও আমানতকারীরা। তাঁরা দাবি করতে থাকেন “সুদ চাই না। অন্তত মূল জমা টাকাটা ফিরিয়ে দেওয়া হোক।” দেশবন্ধুপাড়ার সোমা চক্রবর্তী, গুরুঙ্গবস্তির সুচিত্রা সাহাদের মুখে মুখে প্রশ্ন, “এ বার কী হবে!” পরে এজেন্ট ও আমানতকারীদের একাংশ উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের সামনেও বিক্ষোভ দেখান। এ দিন বিকেলে কোচবিহারের তুফানগঞ্জে সারদা গোষ্ঠীর অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় জনতা। অফিসের বিভিন্ন জিনিস তছনছ এবং কম্পিউটার লুঠ করা হয় বলে অভিযোগ। মাথাভাঙা, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারেও সারদা গোষ্ঠীর অফিসের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে।
হিলি সীমান্তের ত্রিমোহিনী এলাকায় প্রায় ৪০ বিঘা জমি কিনে নার্সিংহোম এবং হিমঘর তৈরি করা হবে বলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। এলাকাবাসীর একটা বড় অংশের দাবি, “প্রকল্পগুলি হবে আশ্বাস পেয়ে আমরা সস্তা দরেই জমি বিক্রি করি। এখন মনে হচ্ছে, প্রতিশ্রুতিটা সত্যি ছিল না। আমরা দেষীদের শাস্তি চাই। জমিও ফেরত দিতে হবে।” এ দিন বিকেলে ওই জমিতে দলীয় পতাকা পুঁতে বিক্ষোভ দেখায় কংগ্রেস।
আমানতকারীদের টাকা ফেরত এবং তাঁদের বকেয়া কমিশনের দাবিতে এ দিন চন্দননগর থানায় বিক্ষোভ দেখান সারদা গোষ্ঠীর এজেন্টরা। সংস্থার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে গ্রেফতারের দাবিও তোলেন তাঁরা। বনগাঁ থানায় একই দাবি জানান সারদার স্থানীয় শাখার প্রায় দু’হাজার এজেন্ট। পুরুলিয়া শহরের মুন্সেফডাঙায় ভাড়াবাড়িতে ওই সংস্থার একটি অফিস রয়েছে। শনিবার দুপুরে কিছু যুবক ওই অফিসের দেওয়াল থেকে সারদার নাম লেখা বোর্ড নামিয়ে দেন।
শনিবারও সল্টলেকে সারদা গোষ্ঠীর এজেন্টদের বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। সল্টলেকের এএল ব্লকের একটি বাড়ি থেকে সংস্থার বেশ কিছু নথি পাচারের চেষ্টা চলছিল বলে অভিযোগ। এজেন্টরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রাক ভর্তি নথি আটকান। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দিনভর এফডি, এইচএ, এএইচ ব্লকে একাধিক বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। সে সব বাড়িতে অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেন বা তাঁর পরিবার থাকত বলে পুলিশ জেনেছে। এ দিন রাতে এফডি ব্লক থেকে সংস্থার তিন গাড়ি চালককে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন এজেন্টরা।
বারাসতে সারদা গোষ্ঠীর অফিসেও বিক্ষোভ দেখান এজেন্টরা। থানায় স্মারকলিপি দেন তাঁরা। তবে বারাসত মূলত তেতে ওঠে ‘দে ইলেকট্রনিক্স প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থা উঠে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দু’টি এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে গণ্ডগোলের জেরে। বোমাবাজি ও গুলি চালানোর অভিযোগও ওঠে। প্রায় ১৫টি বাড়ি ভাঙচুর হয়, জনা দশেক বাসিন্দা জখম হন। ঘণ্টা দেড়েক অবরোধ হয় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বারাসতের সুভাষপল্লি ও দ্বিজহরিদাস কলোনির ঠিক মাঝখানে একটি অফিস করেছিল সংস্থাটি। এক-এক জন বাসিন্দার কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকা জমা নেয়। সংস্থাটির অবস্থা খারাপ হতেই মালিক নিমাই দে গা-ঢাকা দেন। সংস্থার অফিস কাদের দখলে থাকবে, তা নিয়ে দু’টি এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন।
আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে আরামবাগের গৌরহাটি মোড়ে ‘ভারত স্মৃতি সমৃদ্ধি প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে এক ভুঁইফোঁড় অর্থ সংস্থার শাখা অফিসে তল্লাশি চালায় পুলিশ। পরে গ্রেফতার হয় সায়ন্তন দে এবং আবদুল মান্নান খাঁ নামে দুই কর্মী। পুলিশের এক কর্তা জানান, আরামবাগের শাখা অফিসের দুই কর্তার খোঁজ চলছে। তারা খানাকুলের বাসিন্দা। তাদের এক জনের গাড়ি পুলিশ আটক করেছে। অফিসটি থেকে কম্পিউটার এবং কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.