সারদা-কাণ্ড
তৃণমূলকে বিঁধতে কোমর বাঁধছে বাম-কংগ্রেস
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার প্রতারণা কাণ্ডকে সামনে রেখে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে শাসক তৃণমূলকে কোণঠাসা করার প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু করে দিল বিরোধী বাম ও কংগ্রেস।
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির হাতে যাঁরা প্রতারিত হয়েছেন, তাঁদের সংগঠিত করে আন্দোলনে নামার নির্দেশ দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। শনিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের পদ্মপুকুরে দলের জেলা কমিটির বৈঠকে বিমানবাবু কর্মীদের ওই নির্দেশ দেন। এই সব ভুঁইফোঁড় সংস্থার প্রতারণার ফাঁদে যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের সিংহভাগই গ্রামবাংলার বাসিন্দা। পঞ্চায়েত ভোটে শাসক দলের বিরুদ্ধে ওই মানুষদের ক্ষোভ কাজে লাগাতে তৎপর সিপিএম। বিমানবাবু এ দিন দলীয় বৈঠকে বলেন, সর্বস্বান্তদের সঙ্গে নিয়ে সরকার-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাঁর পরামর্শ, সাধারণত বড় কোনও সংস্থা বা কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিক-কর্মচারীদের রাজ্য সরকার আর্থিক সহায়তা দেয়। সুতরাং, সারদা গোষ্ঠীতে টাকা রেখে যাঁরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন, তাঁদেরও রাজ্য সরকার আর্থিক সহায়তা করুক এই দাবি তুলতে হবে।
রাজ্যে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই নিশানা করছে সিপিএম। প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেবের তোপ, “এ রাজ্যে সবচেয়ে বড় চিটফান্ড সংস্থার নাম তৃণমূল কংগ্রেস! চিটফান্ড ও মমতা একাকার হয়ে গিয়েছে!” যার জবাব দিতে গিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “গৌতমবাবু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং ইউপিএ-১ সরকারের যোগসাজসেই রাজ্যে মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে।” এই সব সংস্থা বাম আমলেই অনুমোদন পেয়েছিল দাবি করে মুকুলবাবু বলেন, “আমাদের সরকার এই ধরনের কোনও সংস্থাকে অনুমোদন দেয়নি।”
মুকুলবাবু যা-ই দাবি করুন, তাঁর সরকারকেই কাঠগড়ায় তুলে আসরে নেমেছে বিরোধীরা। বামেদের অভিযোগ তারা সরকারে থাকাকালীনই এই সব ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার কাজকর্মে রাশ টানতে কড়া শাস্তির সুপারিশ করে বিল আনা হয়েছিল। সিপিএম সূত্রের দাবি, ২০০৩ সালে এই ধরনের সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি বিল তৈরি করে তা অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। সেই বিলে কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয় রাষ্ট্রপতির তরফে। এক্তিয়ার সংক্রান্ত কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছিল। বিলটি ফেরৎ পাঠানো হয়। ২০০৯ সালে বিলটিতে ওই সব পরিবর্তন করে সেটি ফের রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। সেই থেকে বিলটি পড়েই আছে। সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, তাঁরা যত দিন সরকারে ছিলেন, বিলটির ব্যাপারে রাজ্যের অর্থসচিব একাধিক বার কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে বিলটিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি আদায়ের জন্য তারা কোনও তৎপরতাই দেখায়নি। ফলে বিলটি নিয়ে নড়াচড়া একেবারেই বন্ধ হয় যায়। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, এই ধরনের আর্থিক সংস্থার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে একটি বিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
ভুঁইফোড় অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ে তৃণমূলকে বিঁধতে ছাড়ছে না কংগ্রেসও। এবং তারাও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য এ দিন অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সচিন পায়লট ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। কেন তার পরেও রাজ্য কোনও ব্যবস্থা নেয়নি এই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “অসম, ত্রিপুরা ওই ধরনের সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল। এ রাজ্যও তেমন নিলে এই সর্বনাশ হত না।” ভুঁইফোঁড় সংস্থাটির সঙ্গে রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক ছিল কি না, তা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে জানানোর দাবিও তুলেছেন তিনি। তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরাও ওই সংস্থার সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত ছিলেন কি না, সে তথ্য প্রকাশের দাবিও তুলেছেন প্রদীপবাবু।
তৃণমূলের নেতা, সাংসদ ও মন্ত্রীদের সঙ্গে ভুঁইফোঁড় সংস্থার যোগ নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে মুকুলবাবু বলেন, “ওঁরা প্রমাণ দেখান।” সারদা-র কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে তৃণমূল আশ্রয় দিচ্ছে বলে সিপিএম যে অভিযোগ তুলেছে, তাকেও উড়িয়ে তিনি বলেন, “মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ।’’
ভুইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গ্রামাঞ্চলে তৃণমূলের বিশ্বাসযোগ্যতায় বড় ধাক্কা লাগবে বলেই মনে করছে বামেরা। একই মত কংগ্রেসেরও। তাদের বক্তব্য, রাজ্যের অর্থনীতির ভিত্তি ধসিয়ে দেওয়ার দায় তৃণমূল অস্বীকার করতে পারে না। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী নিয়মিত অভিযোগ করেন, রাজ্য কোষাগারে টাকা নেই। অথচ, এই সংস্থাগুলির রমরমার ফলেই রাজ্যের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের পরিমাণ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ক্ষুদ্র সঞ্চয় না থাকায় তার বিনিময়ে রাজ্য ঋণ নিতে পারেনি বলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ তুলেছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া। একই অভিযোগ তুলে সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী এ দিন মালদহে জানান, রাজ্যে স্বল্প সঞ্চয় কমে যাওয়ায় রাজ্য সরকারকে বাজার থেকে ঋণ করতে হয়েছে। অর্থাৎ, ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির রমরমায় দু’দিক থেকে ক্ষতি হয়েছে। এক দিকে, বেশি সুদের আশায় বহু মানুষ টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। অন্য দিকে, রাজ্যের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
সিপিএমের মতে, ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি থেকে তৃণমূল এখন দূরত্ব বাড়াতে চাইলেও তা কঠিন। শনিবার মালদহে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, “চিটফান্ডের টাকায় তৃণমূল চলছে! তার প্রমাণ বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা চিটফান্ড নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব আনতে গেলে সে দিন তৃণমূলের বিধায়করা আমাদের বিধায়কদের উপর হামলা করেছেন। সে দিন তৃণমূল বিধায়করা আলোচনা করতে দেননি।” বিরোধীদের আরও অভিযোগ, তৃণমূলের ছত্রছায়াতেই সারদা গোষ্ঠীর মতো একাধিক ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা বিভিন্ন ভাবে সেই সব সংস্থার সঙ্গে জড়িয়েছেন। এক বিরোধী নেতার কথায়, “এখন কেন্দ্রীয় সরকার যখন এ ব্যাপারে কড়া আইন আনার কথা বলছে, তখন তৃণমূল এমন অবস্থান দেখানোর চেষ্টা করছে, যেন তারাই প্রথম ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার প্রকোপ থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য সক্রিয় হল!”
পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লিতেও নড়েচড়ে বসেছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতারা। সামনেই লোকসভার অধিবেশন। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সে ব্যাপারে নজর রেখে শীর্ষ বাম নেতারা ময়দানে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত জানান, ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ে সংসদে সরব হবেন। তাঁদের দাবি, সব অর্থলগ্নি সংস্থাকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আওতায় আনা হোক এবং সেবি সেগুলির নজরদারি করুক। এই ঘটনায় সিবিআই তদন্ত চেয়েছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.