ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে দলের নেতাদের একটি অংশের জড়িত থাকা নিয়ে এ বার ঘরে-বাইরে প্রবল অস্বস্তিতে তৃণমূল। বৃহস্পতিবার সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের নামে এফআইআর দায়ের করা হয়। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ওই সংস্থা এবং অন্যান্য ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে জড়িত দলীয় সাংসদ, নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দলের একাধিক নেতা মুখ খোলেন। দলের প্রথম সারির নেতাদের একাংশ বলছেন, “দলের যে সমস্ত সাংসদ, বিধায়ক বা মন্ত্রী বেআইনি চিট ফান্ডের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের অবিলম্বে বহিষ্কার করা দরকার। দলের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতেই
এই পদক্ষেপ করা উচিত সর্বোচ্চ নেতৃত্বের।”
দলের অন্দরে যখন এই অবস্থা, তখন কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির বাইরের রাস্তায় প্রতিবাদে বসেন ওই সংস্থার বেশ কিছু এজেন্ট। তাঁরা দাবি করেন, সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লগ্নিকারীদের রোষের মুখে পড়তে হবে তাঁদেরই। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের বাঁচানোর দায়িত্ব সরকারের।
এর মধ্যেই অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে সাধুবাদ পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতে দলের মধ্যেকার অস্বস্তিটা ঢাকা থাকেনি। প্রশ্ন উঠেছে, এত দিন বেআইনি ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে দলীয় নেতৃত্ব চুপ ছিলেন কেন? এই বিষয়ে দলের প্রবীণ সাংসদ সোমেন মিত্র শুক্রবার বলেন, “বহু আগে থেকে আমি দলের ভিতরে-বাইরে চিটফান্ডের রমরমা বন্ধের ব্যাপারে বলে এসেছি। আমার নির্বাচনী কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারের বহু গরিব মানুষ চিটফান্ডের পাল্লায় পড়ে সব হারিয়ে পথে বসেছে।” দলের আর এক সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও জানান, গত এক বছর ধরে তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় সভা করে ভুঁইফোঁড় সংস্থার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করছেন। কিন্তু তাঁর দলের কেউ কোনও পদক্ষেপ করেনি বলে শুভেন্দু ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
প্রতারিত সঞ্চয়কারীদের বাঁচানোর আর্জি জানিয়ে সোমেনবাবু কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকেও চিঠি দিয়েছিলেন। সোমেনবাবুর কথায়, “আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, চিটফান্ডের সঞ্চয়কারীদের বাঁচাতে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা রাখা উচিত।” সেই চিঠি নিয়ে দলের অন্দরে বিতর্কও তৈরি হয়েছিল। সোমেনবাবু বলেন, “আমি মমতাকে বলেছিলাম, এখনই বেআইনি কারবার বন্ধ না হলে পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যুর মিছিল হবে।” দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “চিটফান্ডের মালিক বা কর্তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক নেতারই দহরম-মহরম। ফলে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?”
সেই কাজটাই শেষ পর্যন্ত করা হয়েছে বলে মনে করছে দলের অন্য একটি অংশ। বিশেষ করে মমতা নিজে এই ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার পরে ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ ত্বরাণ্বিত হবে বলেও মনে করা হচ্ছে। মমতার বক্তব্য, “এ ধরনের সংস্থাগুলি সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিল। এখন সেই সংবাদমাধ্যমগুলি বন্ধ হয়ে গেলে বহু মানুষ রুটি-রুজি হারাবেন, যা অত্যন্ত দুঃখের। কী ভাবে ওই সংবাদমাধ্যমগুলি চালু রাখা যায়, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “চাকরি হারানোর ঘটনা দুঃখের ঠিকই, কিন্তু গরিব মানুষের টাকা লুঠ হলে তা মেনে নেওয়া যায় না।”
পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মমতার ওই পদক্ষেপ রাজনৈতিক ভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট এবং লগ্নিকারী, দু’পক্ষই এখন বলছে, সারদার নাম দেখে নয়, তাঁরা টাকা লেনদেন করেছেন সংস্থার সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের যুক্ত থাকতে দেখে। এখন লগ্নিকারী সাধারণ মানুষের রোষ তাঁদের উপরে পড়তে পারে বলে ভয় পাচ্ছেন ওই স্থানীয় নেতারা। এর ছাপ আসন্ন ভোটগুলিতে পড়বে বলেও দলের আশঙ্কা রয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে মমতার কঠোর পদক্ষেপ চাপ হালকা করতে পারে বলে মনে করছেন দলীয় নেতাদের একাংশ।
এর মধ্যে এজেন্টরা স্থানীয় মানুষের রোষ থেকে বাঁচতে এ দিন সোজা চলে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে। নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে শুক্রবার দুপুরে তাঁরা বসে পড়েন কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি-সংলগ্ন রাস্তায়। এজেন্টদের সঙ্গে ছিলেন ওই সংস্থার কয়েক জন কর্মীও। তাঁরা জানান, গত কয়েক মাস ধরে বেতন মিলছে না। শিলিগুড়ির প্রণব মোহান্তি, নিউ ব্যারাকপুরের পল্লব ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুরের তাপস সামন্ত, মধ্যমগ্রামের অশোক ভট্টাচার্য কিংবা শেওড়াফুলির শৈলপ্রসাদ রায়ের মতো হাজার খানেক এজেন্টের দাবি, তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হবে। গ্রেফতার করতে হবে সংস্থার মালিককে। এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে তৃণমূলের কয়েক জন নেতাকেও দেখা যায়। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা অবরোধ চলার পর সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর ফেরার আগে পুলিশ জোর করে তুলে দেয় বিক্ষোভকারীদের। গ্রেফতারও করা হয় বেশ কয়েক জনকে। সন্ধ্যায় বিক্ষোভকারীদের একাংশ তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে যান। তাঁদের এক প্রতিনিধি দল তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কাছে সমস্যা মেটানোর জন্য আবেদন জানান। সেখানেও ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার এক তৃণমূল নেতা। তিনি আবার ওই সংস্থার এজেন্ট।
এজেন্টেদের একাংশ এই বিপর্যয়ের জন্য তৃণমূলের এক সাংসদকে দায়ী করেছেন। তাঁকে বহিষ্কারের দাবিও উঠেছে দলে। মুকুলবাবু বলেন, ‘‘যে সাংসদের কথা বলা হচ্ছে, তিনি তো ওই সংস্থার কর্মচারী ছিলেন। বেতন পেতেন। তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেব?” দলীয় সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাটির সঙ্গে দলের যে নেতা-সাংসদদের ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল, তাঁদের এই ব্যাপারে দলনেত্রীর কাছে বিশদ হিসেব দিতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে এক সাংসদ দলের কাছে হিসেব দাখিল করেছেন।
এই অবস্থায় রাজ্য দায় এড়াতে পারে না বলে অভিমত প্রাক্তন মন্ত্রী-কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার। তিনি বলেন, “আমি বারবার সতর্ক করেছি। যারা সেবি এবং আরবিআই-র নির্দেশিকা মেনে কাজ করছে, তাদের বাদ দিয়ে, বেআইনি সংস্থার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা রাজ্য সরকার নিতেই পারত। আরবিআই এবং সেবির নির্দেশ না মেনে কাজ করলে বা সঞ্চয়কারীরা অভিযোগ জানালে যে কোনও চিটফান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এক্তিয়ার রাজ্য সরকারের আছে।” মুকুলবাবু অবশ্য বলেন, “রাজ্য সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও এক্তিয়ারই নেই।”
বিক্ষোভকারীদের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে যাওয়া প্রসঙ্গে মুকুলবাবু বলেন, “বাংলার মানুষ ভাবে, মমতাদির কাছে গেলে বা আমাদের কাছে এলে সমস্যার সমাধান হবে।” বর্তমান পরিস্থিতির দায় বামফ্রন্টের জানিয়ে মুকুলবাবু বলেন, “এই সমস্ত সংস্থাকে নির্বিচারে ছাড়পত্র দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার।” তবে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র পাল্টা বলেন, “এই সব সংস্থার কারবার বন্ধ করার জন্য বিধানসভায় বিল পাশ করেছিলাম। কিছু খুঁটিনাটি আপত্তি তুলে রাষ্ট্রপতি সেই বিল ফেরত পাঠানোর পরে দু’বছরে তা ফের রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর ব্যাপারে তৎপর হয়নি তৃণমূল সরকার।” তাঁর আশঙ্কা, “সংস্থাটির প্রধান গ্রেফতার হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর মুখ বন্ধ করার চেষ্টা হবে। কারণ, এই সংস্থার সঙ্গে তৃণমূলের বহু নেতা-মন্ত্রী যুক্ত।” কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির অভিযোগ, “ওই সংস্থাগুলি গ্রামের মানুষের কাছ থেকে অর্থ লুঠ করে বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন গ্রামের গরিব মানুষ। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে দ্রুত পদক্ষেপ করতে অনুরোধ করেছি।”
বিরোধীদের এই সব অভিযোগের মুখে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন, “আইনভঙ্গকারী যে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। এ ক্ষেত্রেও প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে।” |