সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তারা কী করেছে, তদন্তে কী অগ্রগতি হয়েছে এবং কেন সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা রাজ্য সরকারকে হলফনামা দিয়ে জানাতে বলল কলকাতা হাইকোর্ট। ২ মে-র মধ্যে রাজ্য সরকারকে এই হলফনামা জমা দিতে শুক্রবার নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতি অরুণ কুমার মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত হবে কি না, ৩ মে সে ব্যাপারে হাইকোর্ট তাদের মত জানাবে।
সারদা-কাণ্ডের ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়া এবং সিবিআই তদন্ত চেয়ে একটি জনস্বার্থের মামলা দায়ের করেছিলেন আইনজীবী বাসবী রায়চৌধুরী। এ দিন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে সেই মামলাটির শুনানি শুরু হয়। আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় শুনানির শুরুতেই বলেন, এই কেলেঙ্কারিতে রাজ্যের অসংখ্য দরিদ্র মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে বর্তমান শাসক দল। একে কেন্দ্র করে প্রতিদিন বিক্ষোভ, ভাঙচুর চলছে। মানুষের হতাশা বিক্ষোভের আকার নিচ্ছে। তাই এই কেলেঙ্কারি শুধু আর্থিক নয়, এক অর্থে রাজনৈতিক-সামাজিক কেলেঙ্কারিও বটে। সুব্রতবাবু বলেন, কোনও রঙ না দেখে যাতে নিরপেক্ষ তদন্ত হয় এবং মানুষকে ফেরত দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা তুলে আনা যায়, সেই জন্যই সিবিআই তদন্তের প্রয়োজন।
এই বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অসংখ্য দরিদ্র, মধ্যবিত্ত মানুষ প্রতারিত হওয়ায় কলকাতা হাইকোর্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই বিষয়ে সিবিআই তদন্ত চাওয়াটাই যে উচিত, সেই ইঙ্গিতই এ দিন দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী বলেন, এই সংস্থার কাজকর্ম একটি রাজ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাই সিবিআই তদন্তের দাবি নিয়ে হাইকোর্টকে ভাবতে হবে। বিচারপতি বাগচী সিবিআইয়ের আইনজীবী হিমাংশু দে-কে তাঁদের বক্তব্য জানাতে বলেন। বুধবারই অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ জানান, তিনি সিবিআই-কে তদন্তভার দেওয়ার কথা ভাবছেন।
এ দিন এই মামলায় সেবি, সারদা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি অ্যাসোসিয়েশন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সিবিআই অংশ নেয়। এরা সকলেই সিবিআই তদন্তের পক্ষেই মত দিয়েছে। সেবির আইনজীবী প্রশান্ত দত্ত বলেন, সেবি বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন সংস্থাকে সতর্ক করে এসেছে। তারা ওই সব সংস্থাকে বেশ কিছু নির্দেশও দিয়েছে। সেবি চায়, বিষয়টির যথাযথ তদন্ত হোক। কারণ সাম্প্রতিক কালের মধ্যে এত বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির দ্বিতীয় নজির নেই। সেবি আগেই এই সংস্থাকে জনগণের থেকে আর একটি টাকাও সংগ্রহ করতে নিষেধ করেছিল বলে জানান তিনি। সেবির পরামর্শ, যে টাকা সারদার সংগ্রহে রয়েছে, তা কোনও ভাবেই খরচ করা যাবে না। কোনও সম্পদ কেনাবেচাও করা যাবে না।
প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এ দিন জানিয়ে দেন, সারদা গোষ্ঠীর কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোনও লেনদেন করা যাবে না। ওই সংস্থার স্থাবর এবং অস্থাবর কোনও সম্পত্তি হস্তান্তর করা যাবে না এবং কোনও সম্পত্তি লিজ বা বিক্রি করাও যাবে না। একই সঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, সেবি এই সংস্থার বিরুদ্ধে যে সমস্ত নির্দেশ জারি করেছে, তা যাতে কার্যকর হয়, তা রাজ্য সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
মামলার শুনানিতে নেতাই-কাণ্ডের উল্লেখ করে সুব্রতবাবু বলেন, বর্তমান শাসক দল তখন অভিযোগ করেছিল যে ওই ঘটনায় তৎকালীন শাসক দল সিপিএম যুক্ত ছিল। তার ভিত্তিতেই কলকাতা হাইকোর্ট নেতাই-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। সেটা ছিল একটি গ্রামের কয়েক জন মানুষের ব্যাপার। আর এই কেলেঙ্কারি গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা যে সরাসরি এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত, তা মানুষ বুঝতে পারছেন।
রাজ্যের পক্ষে সরকারি কৌঁসুলি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সরকার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। মূল অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করা হয়েছে। তদন্তের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে তাই সরকারকে আর একটু সময় দেওয়া উচিত। সরকারের এই বক্তব্য মেনে নিয়ে ২ মে পর্যন্ত সময় দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ। ২ মে-র মধ্যে আবেদনকারী সব পক্ষকে হলফনামার প্রতিলিপি সরবরাহ করতে হবে। ৩ মে মামলাটির পরবর্তী শুনানি হবে। ডিভিশন বেঞ্চ সে দিনই সিবিআই তদন্ত সম্পর্কে তাদের মত জানাবে।
|