টাকা ফেরাতে নির্দেশ সেবির
রাজ্য চাইলে তদন্তে রাজি সিবিআই
রাজ্য সরকার চাইলে সারদা গোষ্ঠী-সহ পশ্চিমবঙ্গের ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির সার্বিক কাজকর্ম নিয়ে তদন্ত করতে প্রস্তুত সিবিআই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাটির মুখপাত্র ধারিণী মিশ্র আজ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “বিভিন্ন সূত্র থেকে আমাদের কাছে বিভিন্ন তথ্য এসেছে। কিন্তু সিবিআই রাজ্য সরকারের সুপারিশের ভিত্তিতে অথবা আদালতের নির্দেশে তদন্ত করতে পারে।” আইন মোতাবেক সিবিআইকে এই জাতীয় বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি-ও। ইতিমধ্যেই সারদা গোষ্ঠীর কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে তারা। তাতে বেশ কিছু অনিয়মেরও হদিশ মিলেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবারই সেবি সারদা গোষ্ঠীকে তাদের সমস্ত কালেকটিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম (সিআইএস) অবিলম্বে গুটিয়ে ফেলে তিন মাসের মধ্যে আমানতকারীদের সমস্ত টাকা মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আমানতকারীদের পুরো টাকা না মেটানো পর্যন্ত সারদা রিয়েলটি এবং সুদীপ্ত সেন শেয়ার বাজারে লেনদেন করতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছে সেবি।
সিবিআই সূত্রের খবর, সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন গত ৬ এপ্রিল সিবিআই প্রধানের কাছে ১৮ পাতার একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি বেশ কয়েক জন ব্যক্তির নাম করে দাবি করেছেন যে, বিভিন্ন কারণে তিনি এঁদের নিয়মিত টাকা দিতেন। কেন এবং কী ভাবে তাঁর ব্যবসা সম্পূর্ণ ধসে পড়ল, ওই চিঠিতে তা-ও বিশদে জানিয়ে তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে তাঁর পক্ষে আত্মহত্যা করা ছাড়া পথ নেই। সিবিআই দফতরের পক্ষ থেকে স্ট্যাম্প মেরে চিঠিটি আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। চিঠির প্রতিলিপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়েও দিয়েছে তারা।
বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন
সিবিআইয়ের মুখপাত্র অবশ্য আজ চিঠির বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করেননি। তাঁর কথায়, “সিবিআইয়ের কাছে নানা ধরনের অভিযোগ জানিয়ে চিঠি আসে। নির্দিষ্ট কোনও চিঠির বিষয়ে বলা সম্ভব নয়।” মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির ব্যাপারে তদন্ত কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন। এখন তিনি বিষয়টি সিবিআইয়ের কাছেও পাঠাবেন কি না, সেটি কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে স্থির হবে।
সারদা-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। প্রধানমন্ত্রী চান, বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং দোষীদের যথাযথ সাজা হোক। তবে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক মনে করছে, এক জন সুদীপ্ত সেনকে গ্রেফতার করলে বা তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ, গোটা পশ্চিমবঙ্গে অজস্র সংস্থা এ ধরনের ব্যবসা চালাচ্ছে এবং এদের উপর বহু মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল। কেন্দ্র মনে করছে, সারদা-তদন্তের সঙ্গেই পুরো বিষয়টিকে নিয়ে একটি ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশিকা তৈরি করা বিশেষ জরুরি। মমতাও এ ব্যাপারে একমত।
তৃণমূলের অন্দরে অবশ্য এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি আলোড়ন চলছে দলের দুই রাজ্যসভা সাংসদ কুণাল ঘোষ এবং সৃঞ্জয় বোসকে নিয়ে। সিবিআইকে লেখা চিঠিতে সুদীপ্ত যা জানিয়েছেন, তার মর্মার্থ হল, সৃঞ্জয় বোস ও কুণাল ঘোষের সঙ্গে তাঁর চিটফান্ড ব্যবসার কোনও সম্পর্ক ছিল না। সারদা গোষ্ঠীর সংবাদমাধ্যম এবং চ্যানেল পরিচালনার ব্যাপারে তিনি সৃঞ্জয়ের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন। এবং সে জন্য তিনি প্রতি মাসে সৃঞ্জয়কে টাকা দিতেন। আর কুণাল সংবাদব্যবসার সিইও হিসেবে প্রতি মাসে ওই সংস্থার থেকে বেতন পেতেন। যদিও তৃণমূলের অন্দরে দাবি উঠেছে, চিটফান্ডের সঙ্গে না হলেও এঁরা দু’জন যে হেতু সারদার সংবাদব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই এঁদের সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেটি যতটা না আইনগত কারণে, তার থেকেও বেশি নৈতিক কারণে।
মমতার নির্দেশে মুকুল রায় এই দুই রাজ্যসভা সাংসদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন। কুণাল জানিয়েছেন, তিনি সারদা গোষ্ঠীর অন্য কোনও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। শুধু মাত্র সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সৃঞ্জয়বাবুও মুকুল রায়কে জানিয়েছেন, যে তাঁর সংবাদপত্রের সঙ্গে সারদার একটি চ্যানেলের চুক্তি হয়। যাতে ঠিক হয়, ওই চ্যানেলটির অধিকাংশ কর্মী সৃঞ্জয়বাবুর সংবাদপত্রের অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং চ্যানেলটির যাবতীয় সম্পাদকীয় বিষয় সরবরাহ করবেন। গত বছর ৩১ মে দু’পক্ষের এই চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। সৃঞ্জয়বাবুর দাবি, ওই চুক্তি ছিল ব্যবসায়িক সমঝোতার ভিত্তিতে পেশাগত চুক্তি। কুণালবাবু তৃণমূল নেতৃত্বকে জানিয়েছেন, তিনি যে মাসিক বেতন পেতেন, সেই পরিমাণটি রাজ্যসভাকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েওছেন। এখনও পর্যন্ত যা তথ্য মমতার কাছে এসেছে, তাতে কুণাল এবং সৃঞ্জয়ের ইস্তফা দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না বলেই মনে করছে দল।
এখন প্রশ্ন হল, সুদীপ্তবাবু হঠাৎ সিবিআইয়ের কাছে চিঠি দিতে গেলেন কেন? চিঠিতে সুদীপ্তবাবু কোনও তৃণমূল বা সিপিএম নেতাকে দায়ী না করলেও এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আইনজীবী স্ত্রীকে আইনি পরামর্শের জন্য টাকা দিয়েছেন বলে দাবি করেন। কলকাতার একজন ব্যবসায়ী এবং একটি ফুটবল ক্লাবকে সাহায্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলেও তিনি দাবি করেন। অসমের এক কংগ্রেস নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীকেও তিনি সাহায্য করেছিলেন বলে দাবি তাঁর। অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-এর বিরুদ্ধে সক্রিয় একজন কংগ্রেস নেতার কথাও তিনি চিঠিতে জানিয়েছেন বলে সিবিআই সূত্রে খবর। অর্থ মন্ত্রকের অনেকের ধারণা, সুদীপ্তবাবু বুঝতে পেরেছিলেন, বিপদ ঘনিয়ে আসছে। মরিয়া হয়েই তিনি চিঠিটি লেখেন।
সুদীপ্তবাবুর ব্যবসা কেন এ ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল, সে প্রশ্নও উঠছে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা জানাচ্ছেন, এর কারণ অসমের ব্যবসায় ধস নামা। সেখানে সুদীপ্তবাবুর ব্যবসা ভাল চলছিল। কিন্তু ইউপিএ থেকে মমতা সমর্থন তোলার পর ও চিদম্বরম অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়। একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে সেবি ও অর্থ দফতর ময়দানে নামে। নানা অভিযোগের ভিত্তিতে তরুণ গগৈ অসমে সারদা গোষ্ঠীর কার্যকলাপ বন্ধ করে দেন। ফলে সঙ্কটে পড়েন সুদীপ্ত।
২০১০-এর ২ জুন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল চিটফান্ড সংস্থাগুলির দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি করেন। মোট ১৬টি সংস্থার নাম দিয়েছিলেন তিনি। সারদা গোষ্ঠীর নামও ছিল। দলের সাংসদ কে ডি সিংহের অ্যালকেমিস্ট গোষ্ঠীর কথাও ছিল। সারদা-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূলের অন্দরে কে ডি সিংহ বিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। যদিও কে ডি বলেছেন, তাঁর কোনও চিটফান্ডের ব্যবসা নেই। তৃণমূল সাংসদ সোমেন মিত্র ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাছে একাধিক চিঠি লেখেন। একই কারণে চিঠি দেন কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সিও। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক জানাচ্ছে, ১৯৭৬ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এই ব্যবসা শুরু হয়েছে। এক বার অশোক মিত্র এই লুঠ বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সঞ্চয়িতাকে বন্ধ করে দেন। পরে অসীম দাশগুপ্ত কিছুটা সক্রিয় হন। তখন ওভারল্যান্ড-সহ কিছু সংস্থা বন্ধ হয়। এর পরে অবশ্য বামফ্রন্ট জমানায় এই ব্যবসা বন্ধ করা যায়নি। এখন মমতার শাসনের ২২ মাসে সংস্থাগুলির রমরমা বেড়েছে। এ ব্যাপারে যে চলতি আইন আছে, তাতে এগুলিকে বন্ধ করার প্রত্যক্ষ ক্ষমতা নেই রাজ্য সরকারের। তাই মমতা চান, রাজ্যের হাতে শক্তিশালী আইন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.