ক’দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, সারদার মালিক উত্তরের কোনও রাজ্যে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। মঙ্গলবার কাশ্মীরের মাটি থেকেই সপার্ষদ পাকড়াও হলেন সুদীপ্ত সেন।
কাশ্মীরের শোনমার্গের একটি হোটেলে এ দিন সুদীপ্ত এবং তাঁর দুই ছায়াসঙ্গী দেবযানী মুখোপাধ্যায় ও অরবিন্দ সিংহ চৌহানকে গ্রেফতার করে কাশ্মীর পুলিশ। কাশ্মীরের আইজি আবদুল গনি মির বলেন, “কলকাতা পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।” কলকাতা থেকে পুলিশের একটি দল এ দিন কাশ্মীর পৌঁছেও গিয়েছে। বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ জানান, বুধবার কাশ্মীরের আদালত থেকে ট্রানজিট রিমান্ড নিয়ে সুদীপ্তদের কলকাতায় আনা হবে।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, সোমবার বেশি রাতে সুদীপ্তদের নজরবন্দি করে ফেলে কাশ্মীর পুলিশ। রাতেই সেই খবর পৌঁছয় এ রাজ্যের পুলিশের কাছে। সেই তথ্য মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয় মঙ্গলবার সকাল পৌনে ৯টা নাগাদ। দিনভর মুখ্যমন্ত্রী খোঁজখবর নিতে থাকেন। যত সময় গড়ায়, পুলিশ নিশ্চিত হয়ে যায় আটক ব্যক্তি সুদীপ্তই। শেষে সন্ধে ৬টা নাগাদ মহাকরণ ছাড়ার ঠিক আগে মুখ্যমন্ত্রীকে পুলিশ জানায়, সুদীপ্ত সেন ধরা পড়েছেন কাশ্মীরে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রাজীব (বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার) তো বলেই দিয়েছে। ‘কনফার্ম’ খবর পাওয়া গিয়েছে। সব কৃতিত্ব ওদের।” |
পয়লা বৈশাখ, ১৫ এপ্রিলের সকাল থেকেই রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন সারদা গোষ্ঠীর এজেন্ট ও আমানতকারীরা। সুদীপ্ত সেন কিন্তু কলকাতা ছেড়েছিলেন তার কয়েক দিন আগেই। পুলিশের অনুমান, আগে থেকেই গা-ঢাকা দেওয়ার ছক কষে রেখেছিলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার। সেই জন্যই ৬ এপ্রিল সিবিআইকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, গত ক’বছরে তিনি কাদের কত টাকা দিয়েছেন।
প্রাথমিক জেরায় পুলিশ জেনেছে, ১০ তারিখ ভোরে টাটা সুমো গাড়িতে করে সংস্থার প্রধান কার্যালয় সল্টলেকের মিডল্যান্ড পার্ক থেকে বেরিয়ে যান সুদীপ্তরা তিন জন। বিকেলে পৌঁছন রাঁচি। সেখানে হোটেলের দু’টো ঘর ভাড়া নেন তাঁরা। একটিতে ছিলেন সুদীপ্ত ও দেবযানী, অন্যটিতে অরবিন্দ। পুলিশ জানাচ্ছে, রাঁচি অরবিন্দর হাতের তেলোর মতো চেনা। দিল্লির বাসিন্দা হলেও দীর্ঘদিন রাঁচিতে রয়েছেন অরবিন্দ। সারদা গোষ্ঠীর ‘রিজিওনাল ম্যানেজার’ হিসেবে ঝাড়খণ্ডের ব্যবসা সামলাতেন তিনিই।
পুলিশ জানতে পেরেছে, রাঁচিতেই গাড়ি এবং চালক বদল করেন সুদীপ্তরা। যে গাড়িতে চেপে তাঁরা কলকাতা ছেড়েছিলেন, তার চালক তেমন বিশ্বস্ত ছিলেন না। পাছে তার মুখ দিয়ে বেফাঁস কিছু বেরিয়ে যায়, ওই চালককে তড়িঘড়ি ট্রেনে করে কলকাতায় ফিরে যেতে বলেন সুদীপ্তরা। দ্বিতীয় দিনের মাথায় কলকাতা থেকে অন্য একটি এসইউভি গাড়ি আনিয়ে নেন সুদীপ্তরা। তার নম্বর ডব্লিউবি ২২ ইউ ৬৭৪২। সেটা চেপেই তাঁরা রাঁচি ছেড়ে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন ১২ এপ্রিল। চালকের আসনে এ বার খোদ অরবিন্দই। প্রথম জীবনে গাড়ি চালানোই পেশা ছিল অরবিন্দের। সেখান থেকেই সারদা গোষ্ঠীতে কাজ নিয়ে ধীরে ধীরে উপরের সারিতে উঠে এসেছিলেন তিনি। সুদীপ্ত জানতেন সে কথা। অরবিন্দের উপরে ভরসা করেই গাড়ি নিয়ে দিল্লিতে পৌঁছন তাঁরা। তারিখটা ১৩ এপ্রিল।
দিল্লি থেকে পঞ্জাব, হরিদ্বার, হলদোয়ানি ও উধমপুর হয়ে সোমবার রাতেই কাশ্মীরে ঢোকেন সুদীপ্তরা। এই ন’দিন বিভিন্ন শহরে ডেরা বাঁধলেও কোনও হোটেলে এক রাতের বেশি থাকেননি। ফোনে কথা বলেননি। ট্রেন বা বিমানে ভরসা না করে নিজেদের গাড়িতেই ঘুরেছেন পুরোটা (এমনিতেও বিমানে বিশেষ চড়তেন না সুদীপ্ত)। কিন্তু গোল বাধাল গাড়ির নম্বরপ্লেট।
পুলিশ-কর্তারা জানাচ্ছেন, কাশ্মীরে ঢোকার আগে থেকেই পুলিশের নজরে ছিল সুদীপ্তর গাড়িটি। যে রাস্তা দিয়ে তাঁরা পালাচ্ছিলেন, সেই সব হাইওয়ের টোল প্লাজাগুলিতে গাড়ির নম্বর মিলিয়ে দেখছিলেন বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে থাকা তদন্তকারীরা। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ সব রাজ্যকেই সতর্ক করে দিয়েছিল। জঙ্গি উপদ্রবের জন্য কাশ্মীরের রাস্তায় এমনিতেও তল্লাশির কড়াকড়ি বেশি। তার উপরে সুদূর পশ্চিমবঙ্গের নম্বর প্লেট দেখে আরও সন্দেহ বাড়ে কাশ্মীর পুলিশের।
কাশ্মীরের আইজি আবদুল গনি মির জানান, শোনমার্গে যে হোটেলে সুদীপ্ত সেনরা উঠেছিলেন, তার পার্কিং লটে ভিন রাজ্যের নম্বর লাগানো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁদের সন্দেহ হয়। তারপরেই তাঁরা যোগাযোগ করেন এ রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে। “পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ওই তিন জন সম্পর্কে আগেই আমাদের বিশদে তথ্য পাঠিয়েছিল। ছবিও দিয়েছিল। তার ভিত্তিতেই ওই তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়।” বিভিন্ন টোল প্লাজার সিসিটিভি এবং যে সব হোটেলে তাঁরা রাত কাটিয়েছেন, সেখানকার সিসিটিভি থেকে পাওয়া ছবিও পুলিশকে নিশ্চিত হতে সাহায্য করে।
আর একটি সূত্র ছিল, মোবাইল। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, সোমবার রাতে কাশ্মীরের হোটেলের পৌঁছনোর পরপরই দেবযানী সেখানকার এক কর্মীর মোবাইল থেকে ফোন করেন কলকাতায় তাঁর নিজের আইনজীবীকে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সুদীপ্তর অবস্থান সম্পর্কে এক রকম নিশ্চিত হয়ে যায়। দেবযানীর এই ফোনের কথা স্বীকার করেছে তাঁর পরিবার। তবে দেবযানীর গতিবিধি সম্পর্কে পুলিশের বক্তব্যের সঙ্গে তাঁরা একমত নন। তাঁদের দাবি, দেবযানী সুদীপ্তর সঙ্গে কলকাতা ছাড়েননি। ১০ তারিখ সুদীপ্ত দেবযানীকে ফোন করে দিল্লি চলে যেতে বলেন। দেবযানী সটান দিল্লি যান। তার পরে দেবযানী কলকাতায় ফিরতে চাইলেও সুদীপ্ত তাঁকে ফিরতে দেননি বলে পরিবারের অভিযোগ। দেবযানীর আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতারও দাবি, তাঁর মক্কেল আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশ অবশ্য তা মানছে না। |