লোক দেখানো কারবারে বিনিয়োগ টেনেছে সারদা
গাগোড়াই সাজানো সারদা-সাম্রাজ্য!
মোটরবাইক কারখানা আছে। অথচ সেই কারখানায় মোটরবাইক তৈরি হয় না। যা হয় তা হল, কয়েকটা মোটরবাইকের খাঁচা নিয়ে কাজের অভিনয়।
এখানে-ওখানে আবাসন-প্রকল্পের গালভরা বিজ্ঞাপন আছে। ফ্ল্যাট কেনার জন্য লোকের কাছ থেকে আগাম টাকাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফ্ল্যাটের নামগন্ধ নেই। কোথাও ফাঁকা জমি, কোথাও স্রেফ পাঁচিল।
কারখানা আছে আটা-ময়দা-বিস্কুটের, কিন্তু তা বাজারে দেখেননি কেউই। একটা সিমেন্ট কারখানা আছে, যেখানে কাজ হত কদাচিৎ।
অর্থাৎ বহু শিল্পের বিশাল কাঠামো খাড়া করে রেখেছিলেন সুদীপ্ত সেন। কিন্তু সেটা সিনেমা-সিরিয়ালের সেটের মতো সাজানো। সবই ছিল টাকা বাগানোর আগে লগ্নিকারীদের দেখানোর কুমিরছানা মাত্র।
হুগলির পোলবার মোটরবাইক কারখানার কথাই ধরা যাক। ২০১০ সালে অন্য একটি সংস্থার থেকে দিল্লি রোডের ধারে এই কারখানাটি কিনেছিল সারদা। ঘটা করে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গ্লোবাল অটোমোবাইলস’। কিন্তু গত তিন বছর ধরে এখানে কোনও উৎপাদন হয়নি। কর্মীদের স্রেফ বসিয়ে বেতন দেওয়া হত। তবে এই সময়ের মধ্যে শ্রমিকরা অভিনয়ে রীতিমতো পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। লগ্নিকারীরা এলেই মেশিন চালিয়ে উৎপাদন চালু রাখার অভিনয় করতেন তাঁরা। কারখানার মেন লাইন রেক্টিফিকেশন বিভাগের শ্রমিক লখিন্দর রাম বললেন, “বাইরের লোকজন এলেই আমাদের বলা হতো মেশিন চালানোর অভিনয় করতে। আগের দিন থেকে মেশিন ঝাড়পোঁছ করে রাখতাম। ওদের সামনে শুরু করতাম মেশিন চালাতে।”
ধুবুরিতে সারদা গোষ্ঠীর বন্ধ হয়ে যাওয়া বিস্কুট কারখানা এবং সিমেন্ট কারখানা।
জঙ্গলমহলে অ্যাম্বুল্যান্স হিসেবে বিলি করার জন্য এই কারখানাকেই ৫০টি মোটরবাইক তৈরির বরাত দিয়েছিল রাজ্য সরকার। আগের মালিকের আমলে বিক্রি না-হওয়া মোটরবাইক থেকেই ওই বরাত মেটানো হয়। কারখানার সিইও ইন্দ্রজিৎ চন্দ্রও মেনেও নিচ্ছেন, “এখানে কোনও দিন কোনও উৎপাদন হয়নি। ইদানীং সাইকেল জোড়ার কাজ চলছিল।” বিভিন্ন প্রকল্পে সেই সাইকেলই বিলি করেছে সরকার।
দুই মালিকের আমলে এই কারখানার জন্য মোট ২১৯ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে। আগে কারখানার মালিক ছিলেন শান্তনু ঘোষ। তখন কারখানার নাম ছিল ‘জেনাইটিস’। ২০১০ সালে ৮ একর জমির উপর কারখানাটি কেনেন সুদীপ্ত সেন। সিইও ইন্দ্রজিৎবাবু বলেন, “ঋণ ছিল, তাই জলের দরে মাত্র পাঁচ কোটি টাকায় ওই বিশাল সম্পত্তি কিনে নেন সুদীপ্তবাবু। মাত্র ২৮ কোটি টাকা শোধ করেছিলেন তিনি। তা-ও নির্দিষ্ট সময়সীমা পার করে।” এমনকী, শ্রমিকদের পিএফ এবং ইএসআই বাবদ টাকা কাটা হলেও তা জমা দেওয়া হয়নি সেই ২০১২-র মার্চ থেকেই।
বাঁকুড়ার বড়জোড়া ব্লকের বেলিয়াতোড়ের কাছে ধবনীতে সারদার সিমেন্ট কারখানা অবশ্য পুরোটাই ‘ফাঁকি’ নয়। দিনে ৩০ টনের মতো সিমেন্ট তৈরি হতো সেখানে। শিল্প মহলের মতে যা একেবারেই নামমাত্র। অথচ ২০০৮ সালে কারখানাটি চালু অবস্থাতেই কিনেছিল সারদা গোষ্ঠী। কারখানার অন্যতম মালিক ছিলেন রাজ্যের শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শ্যাম মুখোপাধ্যায়।
‘ল্যান্ডমার্ক সিমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের ওই কারখানায় শ্রমিক ও কর্মচারী মিলিয়ে ৫০ জন কাজ করতেন। মাস তিনেক ধরে বেতন পাচ্ছিলেন না তাঁরা। কারখানা পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পরে চূড়ান্ত হতাশার মধ্যেও যন্ত্রপাতি চুরির আশঙ্কায় রাত পাহারা দিচ্ছেন সমর দাস, চণ্ডী বাউরি, মানিক চট্টোপাধ্যায়রা। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রাক্তন মালিক মন্ত্রী শ্যামবাবু। তাঁর আশ্বাস, “কারখানা চালু করতে শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।”
শিলিগুড়ির আশিগড় মোড়ে সারদা-র আটা-ময়দার কারখানার কর্মীরা অবশ্য পালিয়েছেন। সেখানে অবশ্য আটা-ময়দা তৈরি হতো না। বাজার থেকে স্রেফ প্যাকেটে ভরা হতো। ভাড়াবাড়ির ওই কারখানাও ১৫ এপ্রিল থেকে বন্ধ। ওই দিন সকালে জিনিসপত্র ট্রাকে বোঝাই করে তিন কর্মী পালিয়ে যান বলে বাড়ির মালিক দেবাশিস দাস জানান।
বড়জোড়ায় সারদা গোষ্ঠীর বন্ধ হয়ে যাওয়া সিমেন্ট কারখানা।
সারদার বিস্কুট কারখানা ‘ভাসাঙ্ক ফুডস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর ঠিকানা অসমের ধুবুরি। ৫৮ জন স্থায়ী, ৩৮ জন অস্থায়ী কর্মী এখন অথৈ জলে। কারখানা গত ৩ মাস বন্ধ।
বড় মাপের আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রচার করেছিলেন সুদীপ্ত সেন। সেই ব্যবসার চেহারাটা কী রকম? বলা হয়েছিল, মালদহ পলিটেকনিক কলেজের উল্টো দিকে সাড়ে পাঁচ বিঘা জমির উপর ১২তলা ‘আম্রপালি হাউসিং কমপ্লেক্স’ তৈরি হবে। সব মিলিয়ে ১০২টি ফ্ল্যাট। বেশ কয়েক জন ফ্ল্যাট বুকও করেছিলেন। কিন্তু তৈরি হয়েছে শুধু সীমানার পাঁচিল আর গেট। সুসতানি মোড়ের কাছে আবাসন তৈরির জন্য নেওয়া সাড়ে ৯ বিঘা জমি এখনও ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। কাঁথি শহরে রাস্তার ধারে ‘কন্টাই কনক্লেভ’ নামে ১৯তলা আবাসনের প্লটেও জমি ঘেরা ছাড়া কোনও কাজ হয়নি।
বোলপুর লাগোয়া পাড়ুই থানার কেন্দ্রডাঙালের কাছে দেবাশিস সাহার ‘কোপাই ভিলেজ রিসর্ট’ লজটি ২০১২ সালে ৯৯ বছরের লিজে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা দিয়ে নিয়েছিলেন সুদীপ্ত। সংস্কারের পর গত ৫ ডিসেম্বর নতুন নামে উদ্বোধন হয়েছিল ‘কোপাই টু স্টার ভিলেজ রিসর্ট’-এর। গত ২১ এপ্রিল থেকে সেখানে সব বুকিং বন্ধ। সোমবার থেকে আবার ম্যানেজার-সহ বহু কর্মীই বেপাত্তা। রিসর্টও তালা বন্ধ। ডুয়ার্সের লাটাগুড়িতেও ৫ বিঘা জমিতে তৈরি রিসর্ট প্রায় এক মাস বন্ধ। কর্মীরা জানান, এক মাস বেতন পাননি। বুকিংও নেই। এলাকার লোকজন, যাঁরা রিসর্ট দেখে টাকা আমানত করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন জমি-বাড়ি দখল করে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
স্রেফ ধোঁকার টাটি দেখেই যে সারদায় টাকা ঢেলেছিলেন, ঠেকে বুঝছেন আমানতকারীরা।

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.