নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে আরও এক ধাপ এগোল রাজ্য সরকার। মহাকরণের খবর, সরকারের আর্থিক অপরাধ দমন শাখাকে এ জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে চলেছে
অর্থ দফতর।
সরকারি সূত্রের খবর, গত কয়েক বছরে রাজ্যে কয়েকশো ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা গজিয়ে উঠেছে।
ওই সব সংস্থার বিরুদ্ধে বছরখানেক ধরে দৈনিক ৫-৬টি করে অভিযোগ জমা পড়ছিল অর্থ দফতরে, যার বেশির ভাগই ওই সব সংস্থায় টাকা রেখে প্রতিশ্রুতি মতো ফেরত না পাওয়া। এত দিন মুখ্যমন্ত্রীর সবুজ সঙ্কেত না মেলায় তদন্ত শুরু করতে পারেনি অর্থ দফতর। সম্প্রতি সেই অনুমতি পেয়ে আটঘাট বেঁধে তদন্তে নামার নির্দেশ দিতে চলেছে অর্থ দফতর। এ জন্য আর্থিক দুর্নীতি দমন শাখাকে আরও শক্তিশালী করার কথা ভাবা হচ্ছে।
মোটা টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এই সব সংস্থার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কেন সক্রিয় হচ্ছে রাজ্য?
এর পিছনে মূলত দু’টি কারণ রয়েছে বলে মনে করছে প্রশাসনিক মহল।
প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রমাগত চাপের মুখে ব্যবস্থা নিতে কার্যত বাধ্য হচ্ছে রাজ্য সরকার। এর আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সকলেই কলকাতায় এসে এই সব সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের উপরে প্রকাশ্যেই চাপ তৈরি করেছেন। তৃণমূলের সোমেন মিত্র ও কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরী, এই দুই সাংসদও কেন্দ্রকে চিঠি লিখে এই সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানেও প্রধানমন্ত্রী এই সব সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অমিতবাবুকে বলেন। ক্রমাগত এই চাপের মুখে পড়েই রাজ্য
শেষ পর্যন্ত ওই সব সংস্থার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সক্রিয় হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, এই সংস্থাগুলি বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ায় রাজ্যের অর্থসঙ্কট আরও বাড়ছে। রাজ্যে যে পরিমাণ টাকা স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে জমা থাকে, সরকার সমপরিমাণ অর্থ ঋণ নিতে পারে। অর্থ দফতরের এক সূত্র জানাচ্ছে, বামফ্রন্ট জমানায় ২০০৯-১০ সালে রাজ্য সরকার স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ৭৯৯০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছিল। ২০১০-১১ সালে রাজ্য ঋণ নিতে পেরেছিল ১২ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরে ২০১১-১২ সালে এই ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১৬৫৮ কোটি টাকায়। আর চলতি আর্থিক বছরে রাজ্য স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প থেকে কোনও ঋণ পায়নি।
অর্থ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, চলতি বছরে এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আট মাসে স্বল্প সঞ্চয় খাতে ২১০ কোটি টাকা নিট ঘাটতি (নেগেটিভ ব্যালান্স) হয়েছে। অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বিপুল ফেরতের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে বহু বিনিয়োগকারী ডাকঘরের বদলে ওই সব সংস্থাতেই বিনিয়োগ করছেন।
এই সঙ্কট কাটাতেই ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে অর্থ দফতর অবশেষে নড়েচড়ে বসেছে।
সোমবার ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির রমরমা ব্যবসার প্রতিবাদে অর্থ দফতরের অধিকর্তাকে স্মারকলিপি দেন রাজ্যের সঞ্চয় উন্নয়ন দফতরের কর্মীরা। সংগঠনের সভাপতি নবকুমার বসুর অভিযোগ, এক সময়ে গোটা দেশে স্বল্প সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে প্রথম ছিল পশ্চিমবঙ্গ। অথচ এখন অর্থলগ্নি সংস্থার দাপটে তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। সাধারণ মানুষ যাতে এই সব সংস্থার হাতে সর্বস্বান্ত না হন, সে বিষয়ে সরকারি তরফে কোনও উদ্যোগই নেই বলে অভিযোগ সংগঠনের।
স্বল্প সঞ্চয়কে শেষ করে দিতে সুপরিকল্পিত চক্রান্ত চলছে বলেও অভিযোগ জানান তাঁরা।
কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, চার দফা পদক্ষেপের কথা ভেবেছে সরকার।
এক, আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আটকে থাকা বিলটিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন আদায়। রাজ্যের অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, “এ ব্যাপারে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে চিঠি লিখে ওই আইনটিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেতে আবার দরবার করা হয়েছে।” ওই কর্তা জানান, রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার আগে অবধি আর্থিক অপরাধ দমন শাখায় জমা পড়া অভিযোগের ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুই, আর্থিক দুর্নীতি দমন শাখাকে আরও মজবুত করার জন্য বেশ কয়েক জন ডিএসপি, ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগ করা। যাতে এই সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই জমা পড়া অভিযোগগুলি নিয়ে তদন্ত শুরু করা যায়।
তিন, এফএম রেডিও, বাংলা খবরের কাগজে টানা সাত-দশ দিন বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের সচেতন করা। চার, স্বল্প সঞ্চয় অধিকর্তার দফতর থেকে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের বোঝানো। লিফলেট ছড়িয়ে সেই কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। |