|
|
|
|
মনমোহনকে মমতার আক্রমণে ক্ষিপ্ত কংগ্রেস |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
সখ্য ঘুচেছে চার মাস আগেই। তার পরে প্রধানমন্ত্রীকে নকল করেও দেখিয়েছেন সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে। যে ঘটনার পরে কংগ্রেস নেতারা ছিছিক্কার করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে এ ভাবে ভেঙিয়ে কি আদৌ রুচির পরিচয় দিলেন মুখ্যমন্ত্রী? এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনমোহন-বিরোধী আক্রমণ অন্য মাত্রা নিল। রাজ্যের অনটনের কথা বলতে গিয়ে, বারবার কেন্দ্রের কাছে অর্থ সাহায্য চাওয়ার কথা বলতে গিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, “আমি কি প্রধানমন্ত্রীকে মারব গিয়ে? মারলেই তো লোকে গুন্ডা বলবে। এমনিতেই ওরা (কেন্দ্র) আমাকে গুন্ডা বলে।” |
|
কাছের মানুষ। সোমবার ক্যানিংয়ের সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শামিমা শেখ। ছবি: রাজীব বসু |
ঘটনাচক্রে এ মাসের ৩ তারিখই দু’জন মুখোমুখি হয়েছিলেন। বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, এক মঞ্চে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে নমস্কার জানান মমতা। কিছু কথাও হয় দু’জনের। হাসি মুখে। এবং সেখানেও বক্তৃতায় মমতা বলেছিলেন, “বাংলাকে আরও দিন।” কিন্তু মঞ্চে হাসি মুখে কথা বললেও তার আগে-পরে বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাননি মুখ্যমন্ত্রী। না প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় আসার সময়, না তিনি ফিরে যাওয়ার সময়। ফেরার সময় তো রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বিদায় জানিয়েছেন, কিন্তু অপেক্ষা করেননি মনমোহনের জন্য। রাজ্য সরকারের তরফে অবশ্য বলা হয়েছিল, ইডেনে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে অতিথি ছিলেন মমতা। নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর সেখানে পৌঁছে ক্রিকেটারদের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। তাই প্রণববাবুকে তুলে দিয়েই বিমানবন্দর ছেড়েছিলেন। যদিও রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের কেউ কেউ এই ঘটনাতেও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি মমতার রাজনৈতিক বিদ্বেষই খুঁজে পেয়েছিলেন।
এ দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ের মমতা যা বলেছেন, তাতে অবশ্য শুধু রাজ্য কংগ্রেস নেতারাই নন, অত্যন্ত চটেছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বও। দলের একাধিক নেতা বলেছেন, এ দিনের মন্তব্যে লক্ষ্মণরেখা পেরিয়ে গিয়েছেন মমতা।
মনমোহন সিংহ বা প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় অবশ্য এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, মমতার এই আক্রমণ মূলত রাজনৈতিক। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একে অবজ্ঞা করাটাই সঠিক কাজ। তবে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর সচিবালয় ‘উত্তরে থাকো মৌন’ কৌশল নিলেও কংগ্রেস দল অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে এগিয়ে এসে মমতার বক্তব্যের কড়া নিন্দা করেছে। প্রদেশ কংগ্রেসের নেতাদের পাশাপাশি জাতীয় স্তরে এআইসিসি-র মুখপাত্র রশিদ আলভি বলেছেন, “এই মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক।” তাঁর যুক্তি, প্রধানমন্ত্রী শুধু কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি গোটা দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সম্মান গোটা দেশের সম্মান। কাজেই এই ধরনের মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি দেশেরও সম্মানহানি হয়েছে। আরও কড়া সুরে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি দাবি তুলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখনই প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। দুঃখপ্রকাশ করতে হবে। তাঁর বক্তব্য, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এই বক্তব্য মানায় না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলের নেতাদের মুখে ইদানীং যে ভাষা শোনা যাচ্ছে, তা রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। |
|
তখনও বক্তৃতা দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার, ক্যানিং স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মাঠে।—নিজস্ব চিত্র |
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, এই আক্রমণের পিছনে রয়েছে রাজ্যের আর্থিক অনটন। ভাঁড়ে টাকা নেই, এ দিকে উৎসব-মেলায় দেদার খরচ চলছে বলে অভিযোগ কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলির। তাঁরা আরও বলছেন, রাজ্যে শিল্প বা উন্নয়নের লক্ষণ নেই। টাকা কোথা থেকে আসবে, তার ঠিক নেই। সে সব ঢাকতে এখন মুখ্যমন্ত্রী সভার পর সভায় কেন্দ্রকে দুষে চলেছেন।
বস্তুত, এ দিনের অনুষ্ঠানেও রাজস্ব আদায় নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “আমি রাজস্ব পাই ২১ হাজার কোটি টাকা। ওরা (কেন্দ্র) আমাদের থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিচ্ছে। আমরা কী করে চালাব? কিন্তু আমাদেরও বুদ্ধি আছে। আমরা এই আর্থিক বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করেছি।” এ প্রসঙ্গেই তাঁর সংযোজন, “একটা নিয়ম আছে, কেন্দ্রীয় সরকার যত রাজস্ব আদায় করবে, তার ৩৫ শতাংশ সব রাজ্যের মধ্যে ভাগ করে দেবে। আমরা কত পাই জানেন? ২.৫ শতাংশ। আমি এ সব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কম করে দশ বার বলেছি। এর থেকে বেশি তো কিছু করতে পারি না। আমি কি মারব গিয়ে? মারলেই তো লোকে গুন্ডা বলবে। এমনিতেই তো ওরা (কেন্দ্র) আমাকে গুন্ডা বলে।”
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “আমি বলছি, আমাদের আলাদা আর্থিক সাহায্য দিতে হবে না। সব রাজ্যকে কেন্দ্র যা দিচ্ছে, আমাদেরও তাই দেওয়া হোক। কিন্তু তা হচ্ছে না।” ইন্দিরা আবাস যোজনা, জেএনএনইউআরএম-সহ কয়েকটি প্রকল্পের কথা তুলে তিনি বলেন, “কেন্দ্র বলে ওই সব প্রকল্প ওদের টাকায় চলে। ওরা রাজ্যকে সেই টাকা দেয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এসে বলেন, এত কোটি দিলাম। ওই টাকা কেন্দ্রেরও নয়, রাজ্যেরও নয়। জনগণের।”
এই কথায় স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুব্ধ কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্বও। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কি এই ভাষায় আক্রমণ করেছেন? |
|
বলছিলেন কর্মসংস্থানের কথা। চাকরি হয়েছে কি হয়নি প্রমাণ দিতে
হঠাৎই মঞ্চে
চলে আসতে বললেন
ভিলেজ পুলিশ বাহিনীকে। নির্দেশ দিলেন, “লেফট-রাইট।
জোরে জোরে করো। শরীর-স্বাস্থ্য
ভাল থাকবে।”
সুতরাং শুরু হল
কুচকাওয়াজ। তৃপ্ত মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “গুড।” |
|
দীপা বলেছেন, “যে ভাবে কথা বলছেন, তা হলে কি উনি (মমতা) সত্যিই প্রধানমন্ত্রীকে আঘাত করার পথটাই বেছে নেওয়ার চেষ্টা করবেন? মুখের কথা তো মনেরই প্রতিফলন।” রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেছেন, “উনি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, রাজ্যে এসে বলতেন, বাংলার জন্য ট্রেন দিচ্ছি। তখন তো রাজ্যের টাকা কেন্দ্রের টাকা ভাগ করতেন না।” একই সঙ্গে অধীরের কটাক্ষ, “যাঁর পঞ্চায়েত প্রধান হওয়ার ক্ষমতা নেই, আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তিনিই এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।”
প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী অহেতুক বিদ্বেষ ও সংঘর্ষের পরিবেশ তৈরি করেছেন।” মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে কেন্দ্রকে আক্রমণ করছেন এবং প্রধানমন্ত্রীকেও ব্যক্তিগত ভাবে নিশানা করছেন, তা নিয়ে আগামিকালই মনমোহন সিংহের সঙ্গে আলোচনা করবেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া। তাঁর বক্তব্য, “কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের দাবি থাকতেই পারে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য অপসংস্কৃতির পর্যায়ে পড়ে। আশা করি তিনি ভুল বুঝবেন ও প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবেন।”
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় অবশ্য বলছে, মমতার রাজনৈতিক আক্রমণ সত্ত্বেও কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গে সম্পর্কে কোনও রকম বিমাতৃসুলভ মনোভাব নেবে না বা রাজ্যের প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ হবে না। কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অঙ্গ। উন্নয়ন খাতে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সঙ্কীর্ণ রাজনীতিতে আসতে দেওয়া হবে না।
অর্থাৎ, ইটের বদলে পাটকেল নয়, স্বভাবসুলভ ভাবে সৌজন্যই ফিরিয়ে দিচ্ছেন মনমোহন। |
আমি কি প্রধানমন্ত্রীকে মারব গিয়ে? মারলেই তো লোকে গুন্ডা বলবে।
এমনিতেই তো ওরা (কেন্দ্র) আমাকে গুন্ডা বলে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
স্বল্প-ভাষণ
বক্তৃতা শুরু করেছিলেন তিনটে নাগাদ। সন্ধে ছ’টার কিছু পরে বললেন, “আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন। বাড়ি যেতে হবে। আমি বেশি কথা বলব না।” মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনতে শুনতে পিছনে চেয়ারে বসে মাঝেমধ্যেই ঘুমে ঢুলে পড়ছিলেন চুনী গোস্বামী। শেষ পর্যন্ত বলা যখন থামল, সভাস্থল প্রায় ফাঁকা। মঞ্চের সামনে জেলার কিছু তৃণমূল নেতা, পুলিশ মিলিয়ে হাজারখানেক লোক।
উপোসে জার্সি
ফুটবলারের জার্সি পরে বসেছিলেন পশু চিকিৎসক পলাশ মুন্ডা। ধোলাহাটের বাসিন্দা। বললেন, “রবিবার রাতে পুলিশ থানায় ডেকে ডিমের ঝোল, ভাত খাওয়াল। বলল, দিদির সভায় যেতে হবে। ১০০ টাকা আর ট্র্যাকস্যুট দেওয়া হবে। তাই চলে এলাম।” ট্র্যাকস্যুট জোটেনি। পেয়েছেন জার্সি। তবে খাওয়া জোটেনি দিনভর।
সমীরকে কটাক্ষ
শিল্পী সমীর আইচের নাম করেই মমতা বললেন, “উনি বড় শিল্পী হতে পারেন, কিন্তু তৃণমূলের কেউ নন। মোমবাতি হাতে এক দিন মিছিলে হাঁটলেই পরিবর্তনপন্থী হওয়া যায় না।” সমীরবাবুর প্রতিক্রিয়া, “উনি যে আমাকে শিল্পীর স্বীকৃতি দিয়েছেন এতেই খুশি।”
ওই তো বিদেশ
তিনি খুচরো ব্যবসায় বিদেশি পুঁজির বিপক্ষে। কিন্তু, বিদেশিদের বিপক্ষে নন। কথাটা বলেই মমতা হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিলেন, ওই তো বিদেশ বসু! মঞ্চে বসে চমকিত মোহনবাগানের প্রাক্তন তারকা।
|
ক্যানিংয়ে মমতার প্রতিশ্রুতির বন্যা |
জেলায় লঙ্কাচাষ ভাল হয়। সে জন্য ১০০টি গ্রিন হাউস গ্যাস তৈরি হবে। ৫৫টি বাকি আছে।
• পানের বরজের জন্য সেড নেট হাউস।
• ক্যানিং হাসপাতাল মোড়ে দখলদারদের জমির পাট্টা।
• ৬ মাসের মধ্যে ক্যানিং স্টেডিয়াম।
• সাগরে আরও একটা ‘দিঘা’ হবে।
• ঝড়খালিতে হবে ইকো-ট্যুরিজম প্রজেক্ট।
• মৎস্যজীবীদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে টাকার দেওয়ার প্রক্রিয়া।
• ক্যানিংয়ের ১০০ শয্যার হাসপাতালকে ১৫০ শয্যার করা হবে। থাকবে আইসিইউ, আইটিউ।
• ক্যানিংয়ে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান।
• রাজ্যে ৪টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। জুন থেকে উপাচার্য নিয়োগ হবে।
• ডায়মন্ড হারবারের বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতিকে আসতে অনুরোধ।
• পাথরপ্রতিমায় পর্যটকদের থাকার জন্য কটেজ হবে।
• সজনেখালি, ঝড়খালি, সাগরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
• কাকদ্বীপে লট-৮-এ আরও একটি জেটিঘাট। |
|
|
|
|
|
|