কোথায় গেল টাকা, তদন্তের গড়িমসিতে উধাও হচ্ছে সূত্র |
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে সারদা লগ্নি সংস্থার ম্যানেজার আকাশ সেনগুপ্ত, ও দুই ক্যাশিয়ার প্রশান্ত বর্মন এবং সুব্রত সরকার ফেরার। দক্ষিণ দিনাজপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিখোঁজ। ফোন ধরলেও পুরুলিয়ার ‘সিনিয়র এজেন্ট’ তমস কুমার বারিক জানান, তিনি এখন ফিরবেন না জেলাতে। নিখোঁজ বর্ধমান জেলার প্রধান কর্ণধার অমর পাল। জেলাগুলিতে সারদা গোষ্ঠীর পদস্থ ব্যক্তিরা এ ভাবেই গা ঢাকা দিচ্ছেন। সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে দরকারি কাগজপত্র, কমপিউটারে রাখা তথ্য। ফলে কোন জেলা থেকে কত টাকা কোথায় গিয়েছে, তার গতিপথ আবছা হচ্ছে।
অথচ আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে দ্রুততাই সাফল্যের প্রধান শর্ত, জানান ‘ডিলয়েট’ অডিট সংস্থার প্রধান পি আর রমেশ। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ‘সত্যম’-এর আর্থিক তছরুপের ঘটনার যে তদন্ত করে সিবিআই, তার নেতৃত্বে ছিলেন রমেশ। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, “যাঁরা সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করতে পারেন, তাঁদের সবাইকে প্রথম সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সংস্থার যত সম্পদ রয়েছে, সে সবও হেফাজতে নেওয়া দরকার। যাবতীয় কমপিউটার পাওয়া দরকার, যাতে ডিজিট্যাল সাক্ষ্য লোপাট না হয়। তারপর সময় নিয়ে জেরা করা, তথ্য বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।” রমেশ বলেন, টাকা খুঁজে বার করতে হলে কেবল শীর্ষ ব্যক্তিদের ধরলেই হবে না, ধরা চাই তাদের নীচে আরও চার-পাঁচটি স্তরের অধিকর্তাদের। এঁরা কথাও বলেন সহজে, আর যা তথ্য দেন তা থেকেই শীর্ষব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা যায়। সত্যম-এর ক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্টের অন্তত চারটি স্তর, এমনকী অডিট সংস্থার লোকেদেরও পুলিশ আটক করেছিল। ‘যে টাকা গিয়েছে তা আর পাওয়া যাবে না’, এই ধারণাকে নস্যাৎ করে রমেশ বলেন, “সত্যম কর্ণধার রামলিঙ্গম রাজু প্রচুর টাকার ‘বেনামি’ সম্পত্তি করেছিলেন। তার প্রতিটারই হদিস পাওয়া গিয়েছে। টাকা কখনও উধাও হয়ে যায় না। কিছু খরচ হলেও, অধিকাংশই চিহ্নিত করা যায়।” |
সারদা গোষ্ঠীর তদন্তের ক্ষেত্রে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সংস্থার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন সিবিআইকে চিঠি দিয়ে তদন্তের আর্জি জানানোর পর ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও, জেলাগুলিতে সারদার বহু অফিস ‘সিল’ করা হয়নি, জেরা করা হয়নি কর্তাব্যক্তিদের। কলকাতাতেও সারদার প্রধান কার্যালয়ে রাতভর প্রায় চল্লিশ জন মহিলাদের যে দলটি টাকার হিসেবপত্রের কাজ করতেন, তাঁদের যে পুলিশ এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, সে কথা ওই মহিলারাই জানিয়েছেন। পুলিশের এই গা-ছাড়া ভাবে অনেকেই উদ্বিগ্ন। উত্তর দিনাজপুরে তৃণমূলের জেলা সভাপতি, বিধায়ক অমল আচার্য বলেন, “পুলিশ সারদার দফতরগুলি এখনই সিল না করলে নথিপাচারের আশঙ্কা করছি।”
তাঁর আশঙ্কা অমূলক নয়। মঙ্গলবার রাতে পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে খড়্গপুর বাইপাস মোড়ের অফিস থেকে টাকা-কাগজপত্র সরানো হচ্ছে খবর পেয়ে পুলিশ যায়। সাতটি কম্পিউটার ও লক্ষাধিক নগদ টাকা-সহ হাতে-নাতে এক এজেন্টকে ধরে। অথচ নানা জেলায় পুলিশ সুপাররা জানিয়েছেন, এলাকার লোকেদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অভিযোগ না এলে সারদার দফতর সিল করার নির্দেশ নেই। তাই কোনও কোনও দফতর সিল হচ্ছে, কিন্তু বহু দফতরই অরক্ষিত ভাবে পড়ে রয়েছে।
উত্তরবঙ্গে ‘সারদা এজেন্ট, কর্মী ও আমানকারী সমন্বয় কমিটি’-র সদস্যদের দাবি, প্রথম সারির অন্তত ২০ জন কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে এখনই গ্রেফতার না করলে লক্ষ লক্ষ মানুষের থেকে তোলা টাকার হদিস পাওয়া মুশকিল হবে। রাজ্য সরকার গঠিত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের তরফে সব জেলার পুলিশ সুপার, জেলাশাসকদের নিয়ে বৈঠক করে কেন সারদা সংক্রান্ত তথ্য-পরিসংখ্যান জোগাড়ের জন্য জোর দেওয়া হবে না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন কমিটির আহ্বায়ক গৌতম চৌধুরী।
টাকার হদিসে দ্রুততার উপর জোর দিচ্ছেন ‘ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস’-এর প্রবীণ সদস্য গৌতম ভৌমিকও। প্রথম সারির নানা অডিট সংস্থার সঙ্গে যুক্ত গৌতমবাবু জানান, ‘হাওয়ালা’-র মাধ্যমে টাকা একবার বাইরে পাঠিয়ে দিলে তা আর ফেরত আনা দুঃসাধ্য। “সারদা গোষ্ঠীর সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিসও যদি পুলিশ এতদিনে না পেয়ে থাকে, তবে সেটা আশ্চর্যই বলতে হবে। তা ছাড়া এই ধরনের অপরাধের তদন্তে নানা পেশাদারকে যুক্ত হতে হয়। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আয়কর বিশেষজ্ঞ, ফরেন্সিক অডিটর, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, এমন অনেকে থাকেন সেই দলে। গোড়া থেকেই ‘টিম’ তৈরি করা দরকার।”
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক শীর্ষ অফিসারও জানান, দ্রুত সব অভিযুক্তকে ধরতে পারলে তদন্তের ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হয়। কিন্তু স্পষ্ট অভিযোগ, কিংবা ধৃতদের জেরা করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না-পাওয়া পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হলে আইনি জটিলতার আশঙ্কা থেকে যায়।
বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটই মূলত সারদা-কাণ্ডের তদন্ত করছে। সেখানকার গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ অবশ্য আশ্বস্ত করেন, “সংস্থাটির মূল অফিসের সমস্ত নথিই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। মাদার কম্পিউটর থেকে সমস্ত তথ্যও বাজেয়াপ্ত হয়ছে। সব কিছুই পাওয়া যাবে। ধৃতদের পুলিশি হেফাজতে জেরার পরে অন্যদের গ্রেফতার করা হবে। যে যেখানেই পালাক, ধরে আনা হবে।” |