সুদীপ্তর টাকা কোথায়, খুঁজছে পুলিশ
সমে আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ব্যবসা। ফলে নতুন আমানত জোগাড়ে উত্তরপ্রদেশ ও ওড়িশার দিকে নজর দিয়েছিলেন সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। কারণ, পন্জি স্কিমে নতুন টাকার জোগান না থাকলে তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে বাধ্য। কিন্তু তার আগেই কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির ক্রমাগত চাপ এবং এজেন্টদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে পাততাড়ি গোটানোর সিদ্ধান্ত নেয় সারদা গোষ্ঠী। এর আগে অবশ্য আমানতকারীদের টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন সুদীপ্তবাবু। তদন্ত শুরুর পরে এমনটাই জেনেছেন গোয়েন্দারা। সেই সরিয়ে ফেলা টাকা কোথায় গিয়েছে, তা খুঁজে বার করাই এখন পুলিশের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এক তদন্তকারী কর্তা স্বীকার করলেন, মুখ্যমন্ত্রী যে চাইছেন, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে আমানতকারীদের টাকা মেটাবেন, বাস্তবে তা খুবই কঠিন। কারণ, অ্যাকাউন্টগুলিতে টাকা প্রায় নেই।
সুদীপ্ত সেন।
— ফাইল চিত্র
তদন্তকারীদের বক্তব্য, গত দু’তিন বছর ধরেই টাকা সরানোর কাজ করছিলেন সুদীপ্তবাবু। এখনও পর্যন্ত সারদা গোষ্ঠীর যে ৬০টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে (প্রতিদিন অজস্র নতুন অ্যাকাউন্টের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে), তাতে সামান্য কিছু টাকা পড়ে রয়েছে। সরিয়ে ফেলা টাকা কোন পথে গেল, তা জানতেই একটি রাষ্ট্রায়ত্ত এবং দু’টি বেসরকারি ব্যাঙ্কে সারদার অ্যাকাউন্টগুলি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আমানতকারীদের টাকায় অজস্র বেনামি ফ্ল্যাট, জমি কেনা হয়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে অভিযোগ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু সারদার অফিসগুলি থেকে সেই সংক্রান্ত কাগজপত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। তদন্তকারীদের অভিযোগ, টাকা ফেরতের সময় এলেই যাতে বেপাত্তা হতে পারেন, তার আগাম পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন সুদীপ্তবাবু। সেই মতো অনেক আগে থেকেই টাকাপয়সা সরিয়ে ফেলেন তিনি। তদন্তকারী কর্তাটির বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে। তা বেশ কঠিন কাজ। কারণ, সারদা গোষ্ঠীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলি প্রায় খালি করে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক মাসে যে টাকা সংগ্রহ হয়েছিল, তা ব্যাঙ্কে জমা না দিয়ে কোথায় রাখা হয়েছে, সেটাই এখন খোঁজা হচ্ছে। সে জন্য সুদীপ্ত সেন ও তাঁর সহচরদের গ্রেফতার করাটা খুবই জরুরি।”
প্রাথমিক তদন্তের পরে তদন্তকারীদের দাবি, টাকা তোলার কারবার চলত সারদা রিয়েলটির নামে। প্রতিদিনের জমা-খরচের হিসেব জানতেন শুধু ব্যাঙ্কিং অ্যান্ড অপারেশন্সের অফিসারেরাই। সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেওয়া মহিলাদের থেকেই এই বিভাগের উচ্চপদে নিয়োগ করেছিলেন সুদীপ্ত সেন। জনা ছয়েক এমন কর্ত্রীই যাবতীয় কর্মকাণ্ডের খুঁটিনাটি জানেন। এঁদের প্রত্যেককে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট উপহার দিয়ে গিয়েছেন সারদার কর্ণধার। কিন্তু সেখানে কারও সন্ধান মেলেনি।
পুলিশ জানিয়েছে, মনোজকুমার নেগেল নামে যে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁকে ইদানীং খুবই গুরুত্ব দিচ্ছিলেন সুদীপ্তবাবু। নেগেল দুর্গাপুর এলাকার কাজ দেখতেন। সেখানে আমানতকারীরা টাকা ফেরত চাইলে তাদের তিনি ভালই সামলেছিলেন। তা সুদীপ্তবাবুর নজর এড়ায়নি। তিনি বুঝেছিলেন, সংস্থা যে সঙ্কটে পড়তে চলেছে, তাতে এমন একটি ছেলে প্রয়োজন হবে। তাই মনোজকে সংস্থার ডিরেক্টর করে কলকাতায় নিয়ে আসেন তিনি। সল্টলেকের এফবি ব্লকে একটি বাড়ি দেন। সঙ্গে নতুন আমানতের অভাবে ভুগতে থাকা ৯০টি শাখার দায়িত্বও। পুলিশ জানাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত নেগেলের কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে। সংস্থা গুটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাতেও শরিক ছিলেন তিনি। তাই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য, তদন্তের স্বার্থেই সারদা চেয়ারম্যানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে খুঁজে বের করাটা এখন জরুরি। কারণ, দেবযানীদেবীই একমাত্র কর্ত্রী, যিনি টাকাপয়সা ও সম্পত্তি সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য জানেন। মার্চ মাস থেকেই তাঁর খোঁজ নেই। পুলিশ মনে করছে, সঙ্কট বুঝে সবার আগে এই মহিলাই গা-ঢাকা দেন। তদন্তকারী কর্তারা জেনেছেন, বছর পাঁচেক আগে সামান্য বেতনে রিসেপশনিস্ট হিসেবে সারদাতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। চেয়ারম্যানের নজরে পড়ার পর দ্রুত সংস্থার দ্বিতীয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। সুদীপ্তবাবুকে ডাকা হত ‘সেন স্যার’ বলে। আর দেবযানীদেবীকে বলা ‘ম্যাডাম’। দেবযানীদেবীর নামে দুর্গাপুর, ঢাকুরিয়া এবং সাউথ সিটি মিলিয়ে মোট তিনটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
তদন্তকারীদের দাবি, ২০১১ সাল থেকেই সংস্থার হিসেবনিকেশ সব ওলটপালট হয়ে যায়। ফলে ২০১১-১২ সাল থেকে আর সারদার ব্যালান্স শিট তৈরি হয়নি। ২০০৮-০৯ সালে সংস্থা প্রথমে ৬০ লাখ টাকা অগ্রিম আয়কর দেয়। কিন্তু গত তিন বছরে আয়কর দফতরের ঘরে বিশেষ টাকাপয়সা ঠেকাননি সুদীপ্তবাবু। সম্প্রতি আয়কর দফতর ৭৮ লক্ষ টাকা দাবি করেছিল। কিন্তু মাত্র ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন সারদার কর্ণধার। আয়কর দফতর থেকে তাই চাপ দেওয়া হচ্ছিল। এ ছাড়া সেবি, সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও) থেকেও তদন্ত চলছিল। তার জেরে সংস্থা ৬ মাস, ১ বছর মেয়াদি টাকা ফেরতের স্কিমগুলি তুলে দিতে বাধ্য হয়। পুলিশ জেনেছে, এই ছোট স্কিমগুলি থেকেই মোটা টাকা উঠত। এগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সঙ্কট আরও বাড়ে। যে টাকা ছিল, তা আবার ২০১১ সাল থেকে বেনামি সম্পত্তি কেনাতেই ঢালা হয়েছিল। সেই সম্পত্তি উদ্ধারই পুলিশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
তদন্তকারীরা জেনেছেন, এজেন্টদের সর্বশেষ সম্মেলনে সুদীপ্ত সেন বলেছিলেন, কারবার বৈধ করতে সেবির কাছে ৫০০ কোটি টাকা জমা দিতে হয়েছে। সেবির সার্টিফিকেট পেলেই রির্জাভ ব্যাঙ্ক থেকে জমা টাকার ৭৫ ভাগ ঋণ নিতে পারবেন। সেই টাকা পেলেই সংস্থার সঙ্কট কেটে যাবে। কিন্তু তদন্তকারীরা বলেছেন, যে কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, তাতে এই দাবির পক্ষে প্রমাণ মেলেনি। তা হলে কী হয়েছিল? এর জবাব দিতে পারেন একমাত্র সুদীপ্ত সেনই।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.