নতুন জমা আসেনি, টাকা ফেরতের দিনেই ঝাঁপ বন্ধ
সারদা গোষ্ঠীর মালিক সুদীপ্ত সেনের উত্থান যেমন রোমাঞ্চকর, আচমকা তাঁর উধাও হয়ে যাওয়াটাও ততোধিক রহস্যজনক। সংস্থার কারবার নিয়ে তদন্তে যে সব তথ্য উঠে আসছে, তা অবাক করার মতোই বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী অফিসাররা। শুধু সুদীপ্তবাবুর উত্থানই নয়, কেন এবং কী ভাবে তাঁর সাম্রাজ্যের পতনের শুরু, সেই কাহিনিও সামনে এসেছে ওই সব তথ্য থেকে।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ২০০৬-০৭ সাল থেকে এক খণ্ড জমি বা ফ্ল্যাট পাইয়ে দেওয়ার যে স্কিম সারদা শুরু করে, তাতে টাকা ঢেলেছিলেন লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ। আর সেটাই সম্ভবত সারদা তথা সুদীপ্ত সেনের পতনের শুরু। জমি-ফ্ল্যাট পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই স্কিম থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছিলেন সুদীপ্ত। ওই স্কিমটি গতি পায় ২০০৮-০৯ সালে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই স্কিমটিতে অধিকাংশ আমানত শেষ হওয়ার কথা ছিল এই এপ্রিলেই। আমানতকারীদের বকেয়া মেটানোর জন্য ১৬ থেকে ৩০ এপ্রিল সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৬ এপ্রিল থেকেই রাজ্যের সর্বত্র সারদার শাখা অফিসগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের এ এন ব্লকে মিডল্যান্ড পার্কের সারদার সদর দফতরও সে দিন থেকেই বন্ধ। টাকা তোলার কারবারে যাঁরা ছিলেন, মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকেই তাঁরা বেপাত্তা বলে জেনেছে তদন্তকারী দল। এপ্রিলের গোড়াতে দু’এক দিন সুদীপ্ত সেনকে অফিসে দেখা গেলেও কার্যত তিনি সে সময় থেকেই ফেরার। তবে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত তাঁর মোবাইল ফোন খোলা ছিল। অফিসের ঝাঁপ বন্ধ দেখে যখন বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু হয়, সে দিন থেকেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বন্ধ হয়ে যায় তাঁর ফোনও। অনেকে মনে করছেন, তিনি কাছেপিঠেই এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ‘আশ্রয়ে’ রয়েছেন। তবে তদন্তকারী সংস্থার তরফে এ কথা স্বীকার করা হয়নি। তাঁরা জানিয়েছেন, সারদা গোষ্ঠীর মালিকের সন্ধানে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। পেলেই গ্রেফতার করা হবে। সারদা এবং সুদীপ্ত সেনের সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেশের সমস্ত বিমানবন্দরে তাঁর কথা জানিয়ে রাখা হয়েছে। পাসপোর্টও ব্লক করে দেওয়া হচ্ছে। শনিবার বিধাননগর থানার পুলিশ মনোজকুমার নাগেল নামে সংস্থার এক অধিকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। বিধাননগরের গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ জানিয়েছেন, সল্টলেকের দফতর থেকে প্রচুর নথিও উদ্ধার করা হয়েছে। অর্ণববাবুর আরও বক্তব্য, সংস্থার অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষা করতে পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে তাঁদের অনুমান, ওই সংস্থার সম্পত্তির পরিমাণ একশো কোটি টাকারও বেশি।
এখন প্রশ্ন, হাজার হাজার বিনিয়োগকারীকে পথে বসানো এই সুদীপ্ত সেন কে?
সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। —ফাইল চিত্র
কিছু দিন আগে সুদীপ্ত নিজেই বলেছেন, “আমি তো শিল্পপতির ছেলে নই। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে এত বড় প্রতিষ্ঠান গড়েছি। হয়তো যিশুর মতো আমাকেও এক দিন ক্রুশবিদ্ধ হতে হবে।” অনেকেই বলেন আশির দশকের সঞ্চয়নী চিট ফান্ডের মালিক ভুদেব সেনের ছেলে সুদীপ্তবাবু। কিন্তু সুদীপ্তর দাবি, ভুদেব সেন তাঁর তিন কুলের কেউ নন। তাঁর বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী। বাবার অফিস ছিল পার্ক স্ট্রিটে আর মা ছিলেন টেলিফোন ভবনের কর্মী। একেবারে সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে স্বল্প পরিসরে টাকা তোলার কারবার (যা আসলে পনজি স্কিম) শুরু করেন তিনি। ২০০৫-০৬ সালে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে বিপুল পরিমাণ জমি কেনেন। তার পর সেই জমি দেখিয়ে আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা তোলার মূল কারবার শুরু হয়। বলা হয় কিস্তিতে টাকা রাখো, পাঁচ বছর পরে জমি মিলবে। সেই থেকেই রমরমা সারদা গোষ্ঠীর। উঠতে থাকে কোটি কোটি টাকা। ধীরে ধীরে আরওসি-তে (রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ) পঞ্জিকৃত হয় ৫৬টি কোম্পানি। দিল্লির একটি আইনে (লিমিটেড লায়াবিলিটি পার্টনারশিপ আইন) আরও ৩৮টি কোম্পানি পঞ্জিকরণ করা হয়। ওই আইন বলে এই সংস্থাগুলির কোনওটাই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি কিংবা আরওসি-র আওতাধীন নয়। সারদা মালিকের দাবি ছিল, এই সংস্থাগুলি থেকে যত খুশি কোম্পানি ডিপোজিট তোলা যায়। তাঁর লক্ষ্য ছিল, কয়েকশো সংস্থা খুলে শেয়ার, ডিবেঞ্চার, কোম্পানি ডিপোজিট বিক্রি করে টাকা তুলবেন।
সুদীপ্ত এই সাম্রাজ্য চালাতেন কী ভাবে? তদন্তকারীরা জেনেছেন, সুদীপ্তবাবুর প্রতিষ্ঠান চালানোর প্রতি পদক্ষেপে ছিল রহস্য। সারদার সদর দফতর মিডল্যান্ড পার্কের চতুর্থ এবং পঞ্চম তলায় ছিল তাঁর নিজস্ব অফিস। ওই অফিসেই অধিকাংশ সময় বসতেন তিনি। ওই দু’টি তলায় কাজ করতেন ৫০-৬০ জন মহিলা। হাতে গোনা বিশ্বস্ত কয়েক জন পুরুষেরই শুধু প্রবেশাধিকার ছিল চেয়ারম্যানের ওই অফিসে। মহিলা কর্মচারীদের আবার শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরে অফিসে যেতে হত। সেন স্যারের (এই নামেই তিনি অফিসে পরিচিত ছিলেন) ফরমান ছিল, যে হেতু মা সারদার আদর্শে প্রতিষ্ঠান চলে, তাই শাড়ি-সালোয়ার ছাড়া অন্য কোনও পোশাক পরা যাবে না। তদন্তকারীরা আরও জেনেছেন, প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যানের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন দেবযানী মুখোপাধ্যায় (সংস্থার এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর) নামে আর এক মহিলা। টাকা তোলার কারবারের যাবতীয় তথ্য সুদীপ্তবাবু ছাড়া একমাত্র জানতেন তিনিই। মার্চ মাস থেকে তাঁরও খোঁজ নেই বলে জানিয়েছেন তাঁরা। মা সারদার আদর্শে প্রতিষ্ঠান চলে বলে সদর দফতরে কখনও আমিষ খাবারও আসত না। তদন্তকারীরা জেনেছেন, যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সংস্থার কর্তাদের ডাকা হতো মধ্য রাতে। এমনকী, ভোর চারটেতেও বৈঠক করতেন তিনি। তবে তার জন্য আগে থেকে কিছু জানানো হত না। বৈঠকের সামান্য আগে চেয়ারম্যানের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যেত কর্তাদের। তদন্তকারীরা মনে করছেন, হয়তো আগে থেকে জানিয়ে বৈঠক করলে তাঁর অবস্থান অনেকে জেনে যাবে, এই ভয় কাজ করত তাঁর। অফিসে কখনও এক ঘরে বসতেন না তিনি। আজ চার তলায় তো কাল পাঁচ তলায়। এমন অনেক কর্মী রয়েছেন, যাঁরা একই সঙ্গে কাজ করেও সুদীপ্তবাবুকে কখনও দেখেননি। পারতপক্ষে কোনও অনুষ্ঠানে ছবি তুলতে চাইতেন না তিনি। আসলে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রশ্নে সংশয় থেকেই তাঁর এ সব পদক্ষেপ বলে মনে করছেন তদন্তকারী সংস্থা।
এমন রহস্যঘন সারদা গোষ্ঠীর সঙ্কট ঘনিয়ে এল কেন?
সুদীপ্ত সেনের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, ৫ বছরে আমানতের আড়াই গুণ টাকা ফেরত বা জমি, ফ্ল্যাট, বাংলো দেওয়ার স্কিমটি চালু হয় ২০০৬ সালে। ২০০৮-০৯ সাল নাগাদ দুর্গাপুর, বারুইপুর, পুরুলিয়া, বহরমপুরের মতো ২০-২২টি শাখা থেকে কোটি কোটি অঙ্কের টাকা জমা পড়ে। সংস্থার প্রতিশ্রুতিমতো ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ৬০-৬৫ কোটি টাকা ফেরত দিতে হত আমানতকারীদের। কিন্তু গত বছর পুজোর পর থেকেই সংস্থায় টাকার জোগান কমে যায়। কেন্দ্র ও নানা সরকারি তদন্তকারী সংস্থা পশ্চিমবঙ্গের ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করতেই নতুন করে আমানত আসা কমতে থাকে। তাতে অর্থসঙ্কট আরও বাড়ে। নতুন করে আমানত না আসাই সারা বিশ্বে পনজি স্কিমের পতনের অন্যতম মূল কারণ। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এক দিকে আমানতকারীদের আড়াই গুণ টাকা ফেরতের চাপ, অন্য দিকে নতুন টাকা আসা কমে যাওয়ার সাঁড়াশি চাপে সারদা গোষ্ঠী বিপাকে পড়ে যায়। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক খয়রাতিতেও সারদার মোটা টাকা বেরিয়ে গিয়েছে বলে দাবি সংস্থার কর্তাদের। সংস্থাকে ঘুরে দাঁড় করানোর জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি সায়েন্স সিটিতে সাতটি সভা করেন সুদীপ্ত সেন। সেখানে তিনি বলেন, বোলপুর, লাটাগুড়ি, বানারহাট, কাঁথিতে নতুন নতুন প্রকল্পে টাকা ঢালতে গিয়ে কিছুটা আর্থিক সঙ্কট এসেছে। তবে তা কেটে যাবে। ঘোষণা করা হয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবির ছাড়পত্র নিয়ে নতুন ভাবে আসবে সারদা গোষ্ঠী। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি বদলায়নি। এজেন্টরা সদর দফতরে মার্চে বিক্ষোভ দেখান। তত দিনে অর্থাৎ গত দু’তিন মাসে বকেয়া কয়েকশো কোটি ছাড়িয়েছে। সংস্থার মালিক ঘোষণা করেন, ১৬ থেকে ৩০ এপ্রিল সমস্ত টাকা মিটিয়ে দেওয়া হবে। ১৬ এপ্রিল টাকা মেটানো তো দূরের কথা, সদর দফতরই বন্ধ হয়ে যায়। তার এক দিন আগে সংস্থার কর্মীদের মেল করে অফিস বন্ধ হওয়ার কথা জানানো হয়। সেই মেল পাওয়ার পরেই ক্ষিপ্ত কর্মীরা সুদীপ্তবাবুর নামে তিনটি পৃথক অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই এখন তদন্ত করছে পুলিশ।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.