পশ্চিমবঙ্গের ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলির দৌরাত্ম্য নিয়ে তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন করতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার মহাকরণে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে বৈঠক করবেন। আলোচনার পরে তিন সদস্যের কমিশন গড়া হবে বলেই মহাকরণ সূত্রের খবর।
পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের সঙ্গেও কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই ধরনের আর্থিক জালিয়াতি রুখতে তাঁর সরকার যে কড়া আইন তৈরির পক্ষপাতী, সে কথা শিন্দেকে জানিয়েছেন তিনি। মমতার দাবি, ওই সংক্রান্ত একটি বিল তৈরি করে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ছাড়পত্রের জন্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ছাড়পত্র দিতে দেরি করছে বলে তাঁর অভিযোগ। অবিলম্বে তাতে সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার জন্য শিন্দেকে অনুরোধ করেছেন মমতা। ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থার বেআইনি কার্যকলাপ বন্ধে তিনি কতটা আন্তরিক তা বোঝাতে মুখ্যমন্ত্রী শিন্দেকে বলেছেন, এখন বিধানসভার অধিবেশন না-থাকলেও প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্স জারি করে ওই সব সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায় রাজ্য সরকার। এ ব্যাপারে রাজ্যকে বাড়তি ক্ষমতা দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, “চিট ফান্ড সংক্রান্ত মূল আইনটি কেন্দ্রের। তাতে পরিবর্তন এনে ওই ধরনের সংস্থার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার দেওয়া হোক রাজ্যগুলিকে। যাতে ওই সব সংস্থা বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে তাদের সম্পত্তি নিলাম করে টাকা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়।”
সারদা-কাণ্ডের পরে রাজ্যের মতো তৎপর হয়েছে কেন্দ্রও। ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলি কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গে অর্থ সংগ্রহ করছিল, তা খতিয়ে দেখে অবিলম্বে একটি রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। সে জন্য আগামী সপ্তাহে কলকাতা যাওয়ার কথা রয়েছে সেবি এবং মন্ত্রকের আর্থিক বিষয়ক দফতরের একটি যৌথ দলের। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। প্রয়োজনে তদন্তের ভার সিবিআই-এর হাতেও তুলে দেওয়া হতে পারে। |
অর্থ মন্ত্রকের হাতে প্রাথমিক ভাবে যে তথ্য এসেছে তাতে বলা হচ্ছে, শুধু সারদা গোষ্ঠী নয়, পশ্চিমবঙ্গের আরও দশটি আর্থিক সংস্থা বিপাকে পড়তে পারে। রাজ্য সরকারের পক্ষে সেটাও উদ্বেগের কারণ। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা পড়া রিপোর্ট বলছে, বর্তমানে রাজ্যে ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থার প্রায় দু’লক্ষ এজেন্ট রয়েছেন। সারদার ঘটনার পর তাঁদের একটি বড় অংশ এখন কাজ হারানোর ভয় পাচ্ছেন। আশঙ্কায় ভুগছেন ওই সব সংস্থার কর্মীরাও। এই সমস্যা নিয়েও দফায় দফায় বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে নিয়মভাঙা আর্থিক সংস্থাগুলিকে যে কোনও ভাবেই রেয়াত করা হবে না, সে কথাও স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। মমতার কথায়, “আইন ভেঙে মানুষকে সর্বস্বান্ত করা হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনও দোষী ব্যক্তি ছাড়া পাবে না।” এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। চিদম্বরম এখন বিদেশে। আগামিকাল তাঁর দিল্লি ফেরার কথা। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হবে। তবে ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলির ব্যাপারে রাজ্য সরকার যে অবস্থান নিয়েছে তাতে কেন্দ্র মোটের উপর খুশি বলেই অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর।
চিদম্বরমের সঙ্গে কথা হলে স্বল্প সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের নীতি পরিবর্তনের আর্জি জানাবেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, আগে এই সব স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পেই মানুষ টাকা রাখতেন। কিন্তু এই প্রকল্পগুলিতে ক্রমশই সুদ কমিয়েছে কেন্দ্র। ফলে বাড়তি টাকার লোভে ভুঁইফোঁড় সংস্থার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এই সব আর্থিক সংস্থার রমরমা শুরু হওয়ার পরে গত ডিসেম্বরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া একটি বিজ্ঞাপন জারি করে জানিয়েছিল, সানমার্গ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ও আমাজন ক্যাপিটাল নামে দু’টি সংস্থা অত্যধিক সুদের লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলছে। এরা মূলত কাজ করছে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও মধ্যপ্রদেশের একাংশে। দেখা গিয়েছে, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা তুলছে ওই সংস্থাগুলি। বাজার ধরতে এজেন্টদের বিশাল অঙ্কের কমিশনও দিয়েছে তারা। লগ্নিকারীদের আস্থা অর্জন করতে ওই সংস্থা দু’টি কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ছাড়পত্রও দেখাচ্ছে। কিন্তু যে কারণ দেখিয়ে তারা ছাড়পত্র নিয়েছে, আর বাস্তবে যা করছে, তার মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক বলেই বিজ্ঞাপনে জানিয়েছিল আরবিআই।
তাদের নাম ভাঙিয়ে ব্যবসা রুখতে সম্প্রতি একটি বৈঠক করে আরবিআই, সেবি, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক ও কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক। তার পরেই রাজ্যের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে উপরোক্ত দু’টি সংস্থা ছাড়াও রোজভ্যালি রিসর্ট অ্যান্ড প্ল্যানটেশন, বোটানিস্ট বায়োটেক প্রজেক্ট, রেনবো গ্রিন ফিল্ড, সোনালি অ্যাগ্রো, শ্রী অ্যাগ্রোর মতো একাধিক সংস্থাকে নোটিশ পাঠায় কেন্দ্র।
সন্দেহের তালিকায় এত সংস্থা থাকতে শুধু সারদার ক্ষেত্রে কেন কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে? অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “বেছে বেছে কেবল সারদা গোষ্ঠীকেই হেনস্থা করা হচ্ছে এমনটি ভাবা ঠিক নয়। যারা আইন ভাঙছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেবি সারদা-সহ ওই ধরনের সব সংস্থাকে চিট ফান্ডের ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে অন্য ব্যবসা করতে বলেছিল।
বেশ কিছু সংস্থা সেই পরামর্শ মেনে নেয়। কিন্তু সারদা গোষ্ঠী উল্টে বল্গাহীন ভাবে টাকা তোলা বাড়িয়ে দেয়।
শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই সারদা গোষ্ঠীকে বেপরোয়া করে তুলেছিল বলে অনেকের অভিমত। বস্তুত, অর্থ মন্ত্রকের হাতে আসা তথ্যই বলছে যে, রাজ্যে জাল বিস্তার করা আর্থিক সংস্থাগুলির অধিকাংশই শাসক দলের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতার দাবি করেছে। শাসক দলের ‘আশীর্বাদ’কে কাজে লাগিয়ে সহজেই সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছে তারা। ফলে টাকা তুলতেও সুবিধা হয়েছে। মমতা নিজে অবশ্য এই অভিযোগ খারিজ করে বলেছেন, “চিট ফান্ডের দৌরাত্ম্য ১৯৮০ সাল থেকে চলছে। তখন সিপিএম বা কেন্দ্র কেন ব্যবস্থা নেয়নি? মাত্র দেড় বছরের তৃণমূল শাসনে তো ওদের এত রমরমা হতে পারে না!”
সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেনও সম্প্রতি সিবিআই-কে যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে তৃণমূলের দুই সাংসদের পাশাপাশি এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর স্ত্রীকে টাকা দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তিনি লিখেছেন, টাকা সরিয়ে ফেলার জন্য একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তাঁকে চাপ দিয়েছিলেন। তাঁদের পরামর্শেই ১০৭টি সংস্থা খুলেছিলেন তিনি। ওই সব সংস্থার মাধ্যমেই টাকা সরানো হয়। ওই চিঠিতে বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরও নাম করেছেন সুদীপ্তবাবু।
|