ঋণ দেওয়ার নামে কোটি-কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠল বৈদ্যবাটি-শেওড়াফুলি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে। জয়েন্ট রেজিস্ট্রার অফ কো-অপারেটিভের বিভাগীয় তদন্তে ওই নয়ছয়ের অভিযোগের সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছেন বিভাগীয় কর্তারা।
ওই তদন্তে উঠে এসেছে, অন্তত ৫০ কোটি টাকারও বেশি অনিয়ম করা হয়েছে। শুধু মাত্র গত ২০১০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত পাওয়া হিসেব খতিয়ে দেখা হয়েছে। তাতেই ঋণ নিয়ে শোধ না দেওয়ার যে তালিকা তৈরি হয়েছে, তাতে একশো নাম ছাড়িয়ে গিয়েছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হলে অনিয়মের অঙ্কটা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরেই রেজিস্ট্রার অফ কো-অপারেটিভের কর্তারা নড়েচড়ে বসেছেন। তাঁদের নির্দেশে ব্যাঙ্কের এক প্রাক্তন চিফ ম্যানেজারের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন বর্তমান চেয়ারম্যান।
রাজ্য সমবায় দফতর সূত্রের খবর, ব্যাঙ্কের নিয়মরীতির তোয়াক্কা না করে কোটি-কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বৈদ্যবাটি-শেওড়াফুলি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কর্তাদের বিরুদ্ধে। কোনও রকম বন্ধক না রেখেই বিপুল টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। কোথাও নামমাত্র জমির কাগজপত্রের বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে কোটি-কোটি টাকার ঋণ। জাল নথিপত্রের ভিত্তিতে দু’টি ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাকে ঋণ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার এমনও অভিযোগ আছে যে, ব্যাঙ্ক দু’টি সংস্থায় ২ কোটি টাকা খাটিয়েছে। কিন্তু তার জন্য যে নথি ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হয়েছে তা জাল। জয়েন্ট রেজিস্ট্রারের ওই তদন্তে উঠে এসেছে ব্যাঙ্কের তিনটি শাখাতেই নানা অনিয়মের খতিয়ান। মোট ৪৪ পাতার ওই রিপোর্টে ছত্রে ছত্রে রয়েছে অনিয়মের নির্দিষ্ট বহু তথ্য।
বাম আমলে, ১৯৮৩ সাল থেকে শেওড়াফুলি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতির কোনও নির্বাচন হয়নি। অভিযোগ, আদালতে মামলার অছিলায় মনোনীত সদস্যদের দিয়ে কমিটি করে বছরের পর বছর কাজ চালানো হচ্ছিল। রাজ্যে পরিবর্তনের পর পূর্বতন কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গড়া হয়। ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান করা হয় অমিতাভ মজুমদারকে। এই কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে। নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গড়ে তাঁদের
হাতেই ব্যাঙ্কের দায়িত্ব তুলে দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল।
নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ব্যাঙ্কের নথিপত্র ঘেঁটে তাজ্জব হয়ে যান। পূর্বতন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ যে ভাবে ঋণ দিয়েছেন, তা বহু ক্ষেত্রেই আইনের পরিপন্থী বলে তাঁর সন্দেহ হয়। তিনি পুরো বিয়ষটি জানান রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশেই জয়েন্ট রেজিস্ট্রার অফ কো-অপারেটিভ তিন শাখায় তদন্তে নামেন। তাতে যে সব অনিয়ম মিলেছে তার নমুনা এ রকম:
১) শেওড়াফুলি এলাকার এক তেলকল মালিককে প্রথম পর্যায়ে চার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয় কোনও বন্ধক ছাড়াই। পরে ২১. ০৬ শতক জমি বন্ধক হিসেবে রেখে তাঁকেই ফের ঋণ দেওয়া হয় ২ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা।
২) ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে এ পর্যন্ত ১১৭ জন শোধ করেননি। তাঁদের নেওয়া ঋণের অঙ্ক বিপুল।
৩) শেওড়াফুলি এলাকারই এক ব্যক্তিকে ৩ কোটি ১২ লক্ষ টাকার ঋণ দেওয়া হয় বন্ধক হিসেবে মোটে ২ কাঠা ১৩ ছটাক জমি রেখে।
৪) বৈদ্যবাটি এলাকার এক ব্যবসায়ীকে পরপর তিনটি ঋণ দেওয়া হয়েছে। কোনও বন্ধক ছাড়াই দু’বার ১৭ লক্ষ এবং ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। আর এক বার ইটভাটা বন্ধক রেখে ৭০ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়া হয়।
৫) আরও একটি ক্ষেত্রে ১৫ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে কোনও বন্ধক না রেখেই।
৬) রাজারহাটের একটি সংস্থাকে ৯ কোটি ৫ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। কোন চুক্তিতে এবং কীসের ভিত্তিতে তা দেওয়া হল, তার কোনও নথিই নেই ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কাছে।
বর্তমান চেয়ারম্যান অমিতাভবাবু বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্কের ন্যূনতম নিয়মকানুন মানা হয়নি। নানা অসঙ্গতি লক্ষ্য করে আমি রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জানাই। যা কিছু অসঙ্গতি, তা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।” |