ফের তথ্যপ্রযুক্তির বিশেষ আর্থিক অঞ্চল (সেজ) খোয়ানোর মুখে রাজ্য।
বিশেষ আর্থিক অঞ্চল (সেজ) নিয়ে শাসক দলের রাজনৈতিক অবস্থান নয়। মন্দার আশঙ্কায় সংস্থার লগ্নি শিকেয় তুলে রাখার সিদ্ধান্তও নয়। এ বার নতুন করে আরও একটি তথ্যপ্রযুক্তি সেজ খোয়ানোর এই সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার মূল কারণ জমি বিক্রির টাকা নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে সংস্থার জটিলতা।
উত্তরপাড়ায় হিন্দমোটর কারখানার বাড়তি জমিতে তৈরি হওয়ার কথা ওই সেজ প্রকল্প। প্রায় তিন বছর আগে এ জন্য কেন্দ্রের কাছে ছাড়পত্রও মিলেছে। কিন্তু গাঁথা হয়নি প্রকল্পের একটি ইটও। আগামী ১৩ জুলাই পর্যন্ত এই ছাড়পত্রের বৈধতা রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পে কোনও কাজ না-হওয়ায় সময়সীমা বাড়াতে নারাজ কেন্দ্র। মার্চেই অনুমোদন পর্ষদ তা জানিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ জুলাইয়ের মধ্যে প্রকল্পে হাত না দিলে সেজ-এর সুবিধাই বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু জমি বিক্রি থেকে পাওয়া টাকা নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতায় এ পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শুরুর সম্ভাবনা যথেষ্ট কম বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
উত্তরপাড়ায় ৬০ একরের ওই সেজ প্রকল্প ঘিরে জটিলতায় আটকে রয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। থমকে রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ৩০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগও। সেজ নিয়ে শাসক দলের অবস্থানের কারণে ইনফোসিসের বিনিয়োগ তো আটকে আছেই। অন্য দিকে, আগে বিশ্ব বাজারে মন্দার কারণে অনুমোদন পেয়েও তথ্যপ্রযুক্তি সেজ তৈরি থেকে পিছিয়ে এসেছে ভিডিওকন এবং বাটা। তাই এই সব কিছুর উপর এ বার এই সেজও হাতছাড়া হলে তা রাজ্যের শিল্প-ভাবমূর্তির পক্ষে আদৌ ভাল বিজ্ঞাপন হবে না বলে মনে করছে শিল্পমহল।
সমস্যার শিকড় কোথায়?
২০০৬ সালে সি কে বিড়লা গোষ্ঠীর সংস্থা হিন্দমোটরকে চাঙ্গা করতে তাদের ৩১৪ একর জমি বিক্রির অনুমতি দেয় পূর্বতন বাম সরকার। শর্ত ছিল, সংস্থা চাঙ্গা করতে প্রয়োজনীয় ৮৫ কোটি টাকা ওই জমি বিক্রি করে তুলতে পারবে হিন্দমোটর। প্রায় ১০.৫ কোটি টাকায় সংস্থাকে ওই জমি বিক্রির অনুমোদন দিয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু বেঙ্গালুরুর সংস্থা শ্রীরাম প্রপার্টিজকে জমি বেচে মোট ২৮৫ কোটি টাকা পায় হিন্দমোটর। আমেরিকার দুই সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তারা তৈরি করে বেঙ্গল শ্রীরাম।
কিন্তু গোল বাধে ওই বাড়তি ২০০ কোটি নিয়ে। কারণ, ক্ষমতায় এসে ওই টাকা দাবি করে বর্তমান রাজ্য সরকার। কিন্তু প্রাপ্য মেনে নিলেও বেহাল আর্থিক দশার কারণে টাকা দিতে না-পারার কথা জানিয়ে দেয় হিন্দমোটর। ফলে জমি নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। যার দরুন প্রকল্পের কাজে এক পা-ও এগোতে পারেনি বেঙ্গল শ্রীরাম।
জট কাটাতে দফায় দফায় বৈঠকের পর শেষ পর্যন্ত গত অগস্টে তিন পক্ষের সমঝোতা হয়। মহাকরণ সূত্রে খবর, মুখ্য সচিব স্তরের বৈঠকে ঠিক হয় যে, প্রথমে পাঁচ কিস্তিতে ২৫ কোটি টাকা ফেরত দেবে হিন্দমোটর। তা ছাড়া বেঙ্গল শ্রীরামের প্রকল্প থেকে লভ্যাংশ বাবদ ৪%অর্থ তাদের প্রাপ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর অনুযায়ী যার পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। ফলে ওই টাকা হাতে এলে তা থেকে বাকি টাকা মিটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কথা দেয় হিন্দমোটর। এ জন্য ৪০ একর রাজ্যের কাছে জমা রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় বেঙ্গল শ্রীরামের তরফ থেকেও। কিন্তু বেঙ্গল শ্রীরামের অভিযোগ, সেই রফাসূত্রের ফাইল এখনও আটকে রয়েছে রাজ্য অর্থ দফতরে।
উল্টো দিকে রাজ্য জানিয়েছে, সব দিক খতিয়ে না-দেখে অনুমোদন দেওয়া যাবে না। তাদের দাবি, একেই আগের সরকারের ভুলের মাসুল দিতে হচ্ছে। তার উপর নতুন করে আর কোনও ভুল করতে নারাজ তারা।
ফলে সব মিলিয়ে এই গোটা জটে আটকে রয়েছে বেঙ্গল শ্রীরাম হাইটেক সিটি প্রকল্প। সংস্থার আশঙ্কা, এ ভাবে সময় নষ্ট হলে হিন্দমোটরের কাছ থেকে আর পয়সা ফেরত পাবে না রাজ্য। কারণ চলতি বছরের গোড়ায় তাদের পরিচালন পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূল সংস্থা থেকে চেন্নাইয়ের কারখানা পৃথক করার। ওই কারখানা হিন্দমোটর ফিনান্স নামে শাখা সংস্থার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে। ফলে চালু কারখানা পৃথক হওয়ায় আরও খারাপ হবে সংস্থার আর্থিক হাল। তখন বকেয়া টাকা পাওয়াই সমস্যা হবে। সে ক্ষেত্রে প্রকল্প আরও জটিলতায় পড়বে বলে বেঙ্গল শ্রীরাম কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা।
সম্প্রতি সেজ গড়ার শর্ত বেশ কিছুটা শিথিল করেছে কেন্দ্র। বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি সেজ-এর ক্ষেত্রে তুলে দেওয়া হয়েছে ন্যূনতম জমির প্রয়োজনীয়তাই। তাই এই সুযোগ নিতে ফের সেজ-এ লগ্নি টানতে ঝাঁপাবে অন্যান্য রাজ্য। এই পরিস্থিতিতে নতুন লগ্নি টানা তো দূরস্থান, অনুমোদিত সেজ-ও হাতছাড়া হলে রাজ্য আরও অনেকখানি পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করছে শিল্প। |