শুনানি পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে। কিন্তু সেখানে প্রধান হয়ে দাঁড়াল প্রেসিডেন্সি প্রসঙ্গ।
এর আগে মঙ্গলবার রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন বোঝাতে গিয়ে জবাবি হলফনামায় প্রেসিডেন্সির কথা তুলেছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। বৃহস্পতিবার শুনানির শুরুতেই সেই প্রসঙ্গ তুলে বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার জানতে চান, উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে রাজ্য সরকার যাকে তুলে ধরতে চাইছে, সেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ভাবে হামলা হল?
বিচারপতির সামনে তখন দুই পক্ষের তিন প্রধান আইনজীবী। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে আইনজীবী সমরাদিত্য পাল। রাজ্য সরকারের পক্ষে বিশেষ আইনজীবী জয়ন্ত মিত্র এবং অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়। বাদী ও বিবাদী পক্ষের ওই তিন আইনজীবীই প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন ছাত্র। বিচারপতি সমাদ্দার তাঁদের প্রশ্ন করেন, “এমন কোনও ঘটনা আপনাদের সময়ে কি প্রেসিডেন্সিতে ঘটেছে?” এ ব্যাপারে দু’পক্ষের দুই আইনজীবীই জানান, প্রেসিডেন্সিতে অতীতে অনেক ঘটনা ঘটেছে। নানা বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে। মতবিরোধ হয়েছে। কলেজ উত্তাল হয়েছে। কিন্তু বাইরের লোকের আক্রমণ কখনও হয়নি। এই ভাবে ভাঙচুরের কোনও নজিরও নেই।
সমরাদিত্যবাবু বিচারপতিকে জানান, “আমাদের সময় কলেজে স্টুডেন্টস ফেডারেশন ছিল।” অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমাদের সময় কলেজে পিএসইউ ইউনিয়ন ছিল।” সমরাদিত্যবাবু মৃদু হেসে বিচারপতিকে জানান, “এজি বয়সে ছোট। আমাদের সময়ে কী ছিল, তা উনি জানেন না।” এই সময় জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “শিক্ষকরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ফলেই কলেজগুলিতে এমন হিংসার ঘটনা ঘটছে। প্রেসিডেন্সির ঘটনার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বলেছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী দরকার।”
বিচারপতি সমাদ্দার এই সময়ে মন্তব্য করেন, “এই ধরনের হিংসা নিয়ে রাজনীতি হওয়া উচিত নয়।” আদালতের বাইরে জয়ন্ত মিত্র জানান, তিনি ভাবতেই পারেন না এই ভাবে প্রেসিডেন্সি কলেজ আক্রান্ত হচ্ছে। জয়ন্তবাবুর কাছে এটা লজ্জার। জয়ন্তবাবু প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী সংসদের সহ-সভাপতি। সমরাদিত্যবাবু জানান, প্রেসিডেন্সির ঘটনায় তিনি ব্যথিত, লজ্জিত।
প্রেসিডেন্সির ঘটনাকে সামনে রেখেই এ দিন সওয়াল শুরু করেন সমরাদিত্যবাবু। তিনি বলেন, “দিল্লিতে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র আক্রান্ত হলেন। তার ফলে রাজ্য জুড়ে হিংসা ছড়িয়ে পড়ল। প্রেসিডেন্সিতেও আক্রমণ হল।” সমরাদিত্যবাবু বলেন, এর আগে গার্ডেনরিচে কলেজ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতীদের গুলিতে এক পুলিশ অফিসারের মৃত্যু হয়েছে। মাঠপুকুরে একই রাজনৈতিক দলের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে এক নেতার মৃত্যু হয়েছে। এমন ঘটনা ঘটছে রাজ্য জুড়ে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া শুধু রাজ্য পুলিশ দিয়ে নির্বাচন কমিশন ভোট করাতে পারে না মন্তব্য করেন কমিশনের আইনজীবী।
সমরাদিত্যবাবু বলেন, কমিশনের মূল কাজ মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা। যাঁরা প্রার্থী হতে চান, তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়া। ভোটের দিন যাতে রাজনৈতিক দলের সদস্যরা কোনও ভোটারকে প্রভাবিত করতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে চায় কমিশন। এই সব কিছু খতিয়ে দেখেই ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে তারা।
রাজ্য প্রথম থেকেই পঞ্চায়েত ভোটকে অন্য নির্বাচনের মতো গুরুত্ব দেয়নি বলে মন্তব্য করেন সমরাদিত্যবাবু। তিনি বলেন, রাজ্য সরকারের বক্তব্য ছিল, বিধানসভা ভোটের সঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটের তুলনা চলে না। কিন্তু দিন বদলে গিয়েছে। পঞ্চায়েত গ্রামের সরকার গঠন করে। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনের চরিত্র অনেক জটিল। মানুষের মনে আস্থা বৃদ্ধির জন্য স্পর্শকাতর গ্রামীণ এলাকায় রুট মার্চ, বুথ পাহারার প্রয়োজন। তার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর প্রয়োজন। রাজ্য সরকার কখনও জানায়নি তারা কত সশস্ত্র পুলিশ দেবে। লিখেছে, প্রয়োজনে কলকাতার সশস্ত্র পুলিশকেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই সময় বিচারপতি সমাদ্দার জানতে চান, “বিভিন্ন শপিং মলে পোশাক পরা নিরাপত্তা বাহিনী দেখা যায়। নির্বাচন কমিশন কেমন নিরাপত্তা বাহিনী চাইছে?” সমরাদিত্যবাবু বলেন, নির্বাচন কমিশনের লক্ষ অবাধ মুক্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। ভোটদাতারা যাতে নিজেদের ইচ্ছেমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করা। এরই সঙ্গে শান্তিপূর্ণ রক্তপাতহীন নির্বাচন করাও কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক বেশি।
রাজ্যে কোন নির্বাচনে হিংসা কতটা ছিল, তার পরিসংখ্যান দেন সমরাদিত্যবাবু। তিনি বলেন, ২০০৩ সালে রাজ্য পুলিশ দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়। মারা যান ৫৮ জন। ২০০৮ সালে রাজ্য পুলিশ দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মৃত্যু হয় ২৩ জনের। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কোনও মৃত্যু হয়নি। সে সময় রাজ্যে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। ২০১০ সালে কলকাতা পুরসভা এবং অন্যান্য পুরসভার নির্বাচনে এক জনের মৃত্যু হয়। তখনও ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সহায়তায় বিধানসভা নির্বাচন হয়। এক জনেরও মৃত্যু হয়নি। এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছে।
দীর্ঘক্ষণ কোনও মামলার শুনানি হলে অনেক সময় সওয়াল-জবাব চলতে চলতে বিচারপতি বা আইনজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ সরস মন্তব্য করে থাকেন। আইনি লড়াইয়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে তখন কিছুটা হাল্কা পরিবেশ তৈরি হয়। এ দিনও তেমনই পরিবেশ তৈরি হল বিচারপতির একটি কথায়। ঠিক হয়েছে, কমিশন এবং রাজ্যকে শুনানির জন্য তিন ঘণ্টা করে সময় দেওয়া হবে। এ দিন কমিশনের আইনজীবী কিন্তু পনেরো মিনিট বাড়তি পেলেন। বিচারপতি সমাদ্দার একে উল্লেখ করলেন ‘ইনজুরি টাইম’ বলে। জানালেন, বড় বড় খেলায় অনেক সময় নানা কারণে সময় নষ্ট হয়। তখন রেফারি দায়িত্ব থাকে ইনজুরি টাইম খেলিয়ে দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে এজলাসে যদি কোনও সময় নষ্ট হয়, তা হলে আইনজীবীদের বাড়তি সময় বলার সুযোগ তিনি করে দেবেন। এ দিন যেমন সমরাদিত্যবাবুকে দিলেন।
আজ, শুক্রবার ফের এই মামলার শুনানি হবে। |