|
|
|
|
কোর্টেই কমিশন, প্রায় পঞ্চত্ব পঞ্চায়েতের |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইনের ৪২ ধারাটিকেই বাতিল করার আর্জি নিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। এই ধারার বলে রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা করেছে। আর তাই নিয়ে যত জটিলতা। কমিশন মনে করে, এখন যদি ধারাটিই অবৈধ হয়ে যায়, তবে রাজ্যের হাত থেকে চলে যাবে পঞ্চায়েতের দিন ঘোষণার ক্ষমতা। ভবিষ্যতে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে আর এমন জটও তৈরি হবে না। অর্থাৎ, বাঁশই যদি না থাকে তো বাঁশি বাজবে কী ভাবে!
পঞ্চায়েত নির্বাচনের ৪২ ধারা খারিজের পাশাপাশি রাজ্য সরকার ২৬ এবং ৩০ এপ্রিল পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তা বাতিলেরও আর্জি জানিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন (যাকে কটাক্ষ করে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “এটা হাস্যকর! কারণ, ২৬ তারিখ তো ভোট হওয়া এমনিতেই সম্ভব নয়”)। এ ছাড়াও কমিশনের আর্জি, আদালত রাজ্যকে নির্দেশ দিক যাতে যথাসময়ে সুষ্ঠু ভাবে ভোটপর্ব সমাধা করতে তারা কমিশনকে সাহায্য করে। জরুরি ভিত্তিতে শুনানির জন্যও আবেদন জানিয়েছে তারা।
এই মামলার ফলে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে তৈরি হল ঘোর অনিশ্চয়তা। |
|
সোমবার মহাকরণে সুব্রত-মমতা। —নিজস্ব চিত্র |
হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ, ডিভিশন বেঞ্চ এবং সুপ্রিম কোর্ট ঘুরে কবে যে এই মামলার নিষ্পত্তি হবে, সে সম্পর্কে আইনজীবীদের কারও কোনও সুস্পষ্ট ধারণা নেই। প্রশাসন সূত্রের খবর, ভোটপর্ব মিটিয়ে নতুন পঞ্চায়েত গঠন করতে হবে জুলাই মাসের মধ্যে। তার মানে, সব মিলিয়ে হাতে আর চার মাস। এর মধ্যে আদালতের এতগুলি ধাপ ঘুরে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, নির্বাচন এবং নতুন পঞ্চায়েত তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।
রাজ্য পঞ্চায়েত দফতর সূত্রে বলা হয়েছে, জুলাই মাসের মধ্যে রাজ্যে নতুন ত্রিস্তর পঞ্চায়েত তৈরি না হলে পঞ্চায়েতগুলি অচল হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার আদালতে গিয়ে পঞ্চায়েতগুলিতে প্রশাসক বসানোর আবেদন করতে পারে। রাজ্য প্রশাসনের একটি সূত্রের আবার দাবি, আদালতে না গিয়েও রাজ্য অর্ডিন্যান্স জারি করে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে। তবে এর ফলে গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশ এর মধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, এমন পরিস্থিতি হলে একশো দিনের কাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, এই সব সহায়তা সরাসরি নির্বাচিত পঞ্চায়েতের হাতে যাওয়াই নিয়ম। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও একই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, “কেন্দ্র গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য যে টাকা দেয়, কিছু স্কিমের ক্ষেত্রে নির্বাচিত পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই তা খরচ করতে হয়। পঞ্চায়েত ভোট বন্ধ হয়ে গেলে সে টাকা পাওয়া যাবে না।”
কলকাতা হাইকোর্টের ওই একই এজলাসে এ দিন মামলা দায়ের করে রাজ্য বিজেপিও। তারা রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের ৪২-এর সঙ্গে ৪৩ ধারাকেও অবৈধ ঘোষণার আর্জি জানিয়েছে। ৪২ ধারায় বলা হয়েছে, কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে ভোটের দিন ঘোষণা করবে সরকার। ৪৩ ধারায় সার কথা, সরকারের ঘোষিত দিন পছন্দ না হলে তা পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারে কমিশন। কমিশনের বক্তব্য, ৪২ ধারা বাতিল হয়ে গেলে ৪৩ ধারার অস্তিত্বই থাকবে না। তাই তারা শুধু ৪২ ধারাটিকে অবৈধ ঘোষণার আর্জি জানিয়েছে।
একই বিষয় নিয়ে এ দিন একটি জনস্বার্থ মামলাও দায়ের হয়েছে। হাইকোর্টের আইনজীবী বাসবী রায়চৌধুরী ওই মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন জানান, এই মামলায় রাজ্য সরকারের পাশাপাশি সব জেলার জেলাশাসককে পার্টি করা হয়েছে। সংবিধানের ২৪৩ (কে) ও ২৪৩ (জেড-এ) (১) ধারায় বলা আছে, জাতীয় নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ার একই। তাই রাজ্য সরকার কোনও ভাবেই নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারে না। আবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামের মানুষের গণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার হরণ করতে চাইছে রাজ্য সরকার। নির্বাচন কমিশন যাতে রাজ্য সরকারের খবরদারি থেকে বেরিয়ে মুক্ত, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারে, হাইকোর্ট তা নিশ্চিত করুক।
এ দিন নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁদের হয়ে মামলাটি লড়বেন আইনজীবী সমরাদিত্য পাল। অসুস্থতার জন্য এ দিন সমরাদিত্যবাবু আদালতে হাজির হতে পারেননি। তবে, আজ, মঙ্গলবার তিনিই মামলার সওয়াল করবেন বলে জানিয়েছেন সমরাদিত্যবাবু। |
আদালত ও একটি ভোট |
|
হাইকোর্টে মামলা
দায়ের রাজ্য নির্বাচন কমিশনের |
|
মামলা করেছে বিজেপি,
জনস্বার্থেও একটি মামলা |
|
• মূল মামলার শুনানি শুরু আজ বিকেল ৩টেয়
• মামলা কত দিন চলবে, কেউ জানে না
• আরও কেউ পার্টি হলে মামলার মেয়াদ বাড়তে পারে
• যে পক্ষ মামলায় হারবে, তারা যেতে পারে ডিভিশন বেঞ্চে |
ডিভিশন বেঞ্চে যে হারবে, সে যেতে পারে সুপ্রিম কোর্টে |
• সেখান থেকে মামলা যেতে পারে সাংবিধানিক বেঞ্চে
• সাংবিধানিক বেঞ্চের সিদ্ধান্তই অবশ্য চূড়ান্ত
• আদালত-পর্ব মিটলে তবেই ভোটের প্রসঙ্গ আসবে
• আগামী জুলাইয়ের মধ্যে পঞ্চায়েতগুলির মেয়াদ শেষ
• তার মধ্যে ভোট না হলে কী হবে, তা বলা নেই আইনে
• সে ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতগুলি অচল হয়ে পড়ার আশঙ্কা
• প্রশাসক বসিয়ে চালানো যেতে পারে পঞ্চায়েত
• তার জন্যও আদালতের নির্দেশ লাগবে
• রাজ্যের অবশ্য দাবি, অর্ডিন্যান্স করেও প্রশাসক নিয়োগ হতে পারে
• সে ক্ষেত্রে তাদের আইন সংশোধন করতে হবে |
নির্বাচন কমিশনের আর্জি, বাতিল হোক পঞ্চায়েত আইনের ‘অবৈধ’ ৪২ ধারা। |
কী আছে ৪২ ধারায়:
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে
আলোচনা করে ভোটের দিন ঘোষণা করতে পারে সরকার। |
|
কমিশন যে হাইকোর্টে যাচ্ছে, রবিবারেই তারা সেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। এ দিন বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের এজলাসে কমিশনের আইনজীবী লক্ষ্মীচাঁদ বিয়ানি বলেন, রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে রাজ্য ও কমিশনের মধ্যে একটি সংঘাতের আবহ তৈরি হয়েছে। কমিশন এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। রাজ্য ইতিমধ্যেই ২৬ এবং ৩০ এপ্রিল পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই দু’দিন নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। তাই রাজ্যের ওই বিজ্ঞপ্তি খারিজ করে দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছে কমিশন।
কমিশনের পক্ষে আরও বলা হয়, পঞ্চায়েত ভোটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত না হলে তারা ভোটের দিন ঘোষণা করতে পারে না। রাজ্য কার্যকরী আলোচনা ছাড়াই একতরফা ভাবে দিন ঘোষণা করেছে। তা ছাড়া, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করারও বিরোধী রাজ্য। এই অবস্থায় কমিশন কী ভাবে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট তৈরি করবে, হাইকোর্টের কাছে সেই প্রশ্নই রেখেছেন কমিশনের আইনজীবী।
বিজেপি-র আইনজীবী কৌশিক চন্দ্র বলেন, ভোটের দিন, ক’দফায় ভোট, কোন জেলায় কবে ভোট, কত নিরাপত্তা বাহিনী লাগবে সবই ঠিক করবে কমিশন। এ ক্ষেত্রে রাজ্যের নাক গলানোর অবকাশই নেই।
এই আবেদনের জবাবে বিচারপতি সমাদ্দার বলেন, বিষয়টির গুরুত্ব তিনি স্বীকার করছেন। জরুরি ভিত্তিতে শুনানিতেও তিনি রাজি। প্রথম শুনানি হবে আজ, মঙ্গলবার।
মামলার খবর শুনে এ দিন দুপুরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বলেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় এবং জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বিকেলে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী, পঞ্চায়েতমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন বিমলবাবু ও অশোকবাবু। কী ভাবে রাজ্য মামলা লড়বে, তার রূপরেখা তৈরি হয়। পরে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন,“পিটিশনের কপি পেয়েছি। সেখানে মুখ্যসচিব ও পঞ্চায়েত সচিবকে পার্টি করা হয়েছে। আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করছি। আমাদের বক্তব্য আদালতে জানাব।”
বিমলবাবু বলেন, “সরকারের হয়ে কোন কোন আইনজীবী মামলা লড়বেন, তা ঠিক হয়ে গিয়েছে। সরকার জানাবে, পঞ্চায়েত দফতরের কাজে কোনও ভুল ছিল না।” এ দিন রাতেই পঞ্চায়েতমন্ত্রী আইনজীবী জয়ম্ত মিত্রের বাড়িতে গিয়ে আলোচনা করেন। অ্যাডভোকেট জেনারেল কথা বলেন আর এক আইনজীবী শক্তি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তবে আজ, মঙ্গলবার এঁরা কেউই সরকারের হয়ে সওয়াল করবেন না বলে সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে।
সরকারের এক মুখপাত্র জানান, “নির্বাচন কমিশন ৪২ ধারার বিলোপ চেয়েছে। এটিই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক। ২০০৩ সালের এই আইনে দু’টি পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে। পঞ্চায়েতের উপ-নির্বাচন হয়েছে। সাম্প্রতিক বিতর্কে কমিশনও যে সব চিঠি দিয়েছে, তা পঞ্চায়েত আইনের ৪২ এবং ৪৩ ধারা উল্লেখ করে। তা হলে সেই কমিশনই এখন কেন ধারা দু’টিকে সংবিধান বিরোধী বলছে? সরকার কমিশনের স্ববিরোধিতাকেই আদালতে তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
|
পুরনো খবর: আজই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছে কমিশন |
|
|
|
|
|