প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। প্রশ্নটা একটি জ্যাভলিন বা বর্শা নিয়ে। সেই বর্শার ঠিকুজি-কুলুজি মেলাতে পুলিশ বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্রীড়া বিভাগের স্টক রেজিস্টার বাজেয়াপ্ত করেছে।
পুলিশি সূত্রের খবর, ১০ এপ্রিল প্রেসিডেন্সিতে হাঙ্গামার পরে বেকার ল্যাবরেটরির পাশে যে-বর্শাটি পড়ে ছিল, সেটি ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ক্রীড়া বিভাগের কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন শিল্পমন্ত্রী। নিছক প্রশ্ন নয়, তাঁর সন্দেহ, ওটা ক্রীড়া বিভাগেরই। সেই সূত্রেই এ দিন দুপুরে প্রেসিডেন্সির ক্রীড়া বিভাগে গিয়ে সেখানকার বর্শা পরীক্ষা করেন তদন্তকারীরা। তার পরেই তাঁরা ক্রীড়া বিভাগের রেজিস্টার নিয়ে চলে যান।
বর্শাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া বিভাগের নয় বলে কর্তৃপক্ষ এ দিন তদন্তকারীদের জানান। তাঁদের অভিযোগ, ১০ এপ্রিল যে-সব হামলাকারী গেট ভেঙে বেকার ল্যাবরেটরির কাচ ভেঙেছিল, ওই বর্শা তাদের হাতেই ছিল। তারা সেটি ফেলে যায়। পুলিশি সূত্রে বলা হয়, ক্রীড়া বিভাগে তারা ১০টি বর্শা দেখে এসেছে। এখন রেজিস্টার মিলিয়ে তারা শিল্পমন্ত্রীর তোলা অভিযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছে।
এ দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উপাচার্য মালবিকা সরকারের বয়ান ভিডিও-বন্দি করে পুলিশ। তারা কথা বলে রেজিস্ট্রার প্রবীর দাশগুপ্ত, ডিন অফ স্টুডেন্টস দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী এবং পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান সোমক রায়চৌধুরীর সঙ্গেও। পুলিশ জানায়, ওই চার আধিকারিক আগে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যে-বিবৃতি দিয়েছেন, তার সঙ্গে তাঁদের এ দিনের বক্তব্য মিলিয়ে দেখা হবে। তবে পুলিশ যে-ভাবে তদন্ত করছে, তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনীদের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশ রাজ্যের এক মন্ত্রীর বক্তব্যকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে তাদের আস্থা নেই। পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের গড়া বিশেষ কমিটিও তদন্ত শুরু করেছে। কমিটির সদস্য, প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় এ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, ডিন, অন্যান্য আধিকারিক, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, আজ, শুক্রবারেও জিজ্ঞাসাবাদ চলবে।
হামলার তদন্তের জন্য অমলবাবুকে নিয়ে এক সদস্যের কমিটি গড়েছে মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু অমলবাবু দীর্ঘদিন ধরে প্রেসিডেন্সির সঙ্গে যুক্ত। তিনি প্রাক্তনী সংসদেরও সদস্য। তাই তাঁর কাজে নিরপেক্ষতা কতটা বজায় থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে
অমলবাবু অবশ্য মনে করেন, প্রেসিডেন্সিকে তাঁর মতো ভাল করে কেউ চেনে না। তাই এই কাজের পক্ষে তিনি অন্যতম যোগ্য ব্যক্তি। তাঁর কথায়, “ছাত্র, শিক্ষক, অধ্যক্ষ হিসেবে প্রায় ছ’দশক আমি প্রেসিডেন্সির সঙ্গে যুক্ত। অধ্যক্ষ থাকাকালীনও কি কেউ কখনও আমার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলতে পেরেছেন? কখনও কারও পক্ষ নিয়ে কাজ করেছি, এটা প্রমাণিত হলে এই দায়িত্ব ছেড়ে দেব। পক্ষপাতিত্ব করতে পারিনি বলে জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু নিরপেক্ষতা কখনও ছাড়িনি।”
এ দিন তিনি উপাচার্য, রেজিস্ট্রার-সহ ১৯ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানান অমলবাবু। তাঁদের মধ্যে আট জন পড়ুয়া। ১০ এপ্রিলের ঘটনার কথা জানতে চাওয়া হয়েছে সকলের কাছেই। তাঁরা মূল ফটক এবং মূল প্রশাসনিক ভবনে হামলার কথা জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্সিতে হামলায় সেখানকার দ্বাররক্ষী সন্তোষ (পাপ্পু) সিংহের ভূমিকা কী ছিল, তাঁর পরিচয় কী এ-সব প্রশ্ন তুলেছে শাসক দল। দীর্ঘ ক্ষণ পাপ্পুকে জেরাও করেছে পুলিশ। এ দিন পাপ্পুর সঙ্গে কথা বলে তাঁর কাছ থেকেও হামলার ঘটনার বিবরণ জানতে চান অমলবাবু। পরে রেজিস্ট্রার প্রবীর দাশগুপ্ত জানান, এক-এক করে সকলকে ডেকে কথা বলেছেন প্রাক্তন অধ্যক্ষ। সকলের বক্তব্যই ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়েছে।
আজ, শুক্রবার আরও ১৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। হামলার দিন তাঁরা ছিলেন বেকার ল্যাবরেটরিতে। তাই তাঁদের কাছে বেকার ল্যাবরেটরির গোলমালের খবর জানতে চাওয়া হবে। প্রয়োজনে সোমবারেও চলবে জিজ্ঞাসাবাদ। ১৫ দিনের মধ্যে কমিশনে রিপোর্ট পেশ করা হবে।
এ দিনই মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের তরফে একটি দল প্রেসিডেন্সিতে যায় ঘটনার তদন্তের জন্য। ওই দলের অন্যতম সদস্যা বোলান গঙ্গোপাধ্যায় পরে বলেন, “হাঙ্গামায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মনে করে এপিডিআর। তাই আমরা এসেছি। ১০ এপ্রিল ঠিক কী হয়েছিল, জানার চেষ্টা হচ্ছে।”
প্রেসিডেন্সিতে হামলার নিন্দায় সরব প্রাক্তনী সংসদও। ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও কলেজ স্ট্রিটকে শব্দ-বারণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছে তারা। হামলার বিরোধিতায় সরব প্রেসিডেন্সির আরও অনেক কৃতী প্রাক্তনী। সেই তালিকায় রয়েছেন অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক, অনুপ সিংহ, দীপঙ্কর দাশগুপ্ত, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সব্যসাচী ভট্টাচার্য-সহ ৮০ জন। তাঁরা হামলাকারীদের দ্রুত শাস্তি চেয়েছেন। আর যাতে এমন ঘটনা না-ঘটে, তা নিশ্চিত করতে প্রেসিডেন্সিতে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবিও জানিয়েছেন ওই প্রাক্তনীরা। |