গড়িয়ে গিয়েছে সাত-সাতটা দিন। ঘটনার আট দিনের মাথায় প্রেসিডেন্সি-কাণ্ড নিয়ে ফরেন্সিক বিভাগকে তদন্তে নামার আবেদন জানাল কলকাতা পুলিশ। কিন্তু প্রেসিডেন্সিতে ফরেন্সিক-তদন্তের দরকার পড়ল কেন, এবং পড়লেও এতটা সময়ের ব্যবধানে ফরেন্সিককে ডাকা হল কেন, সে প্রশ্ন ইতিমধ্যে মাথা চাড়া দিয়েছে।
১০ এপ্রিল প্রেসিডেন্সি চত্বরে ভাঙচুর ও ছাত্র নিগ্রহের ঘটনা ঘিরে রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড়। সেই সূত্রে শাসক তৃণমূলের একাধিক নেতা-ছাত্রনেতার দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। সাত দিন কেটে যাওয়ার পরে বৃহস্পতিবার লালবাজারের তরফে ফরেন্সিক বিভাগকে তদন্ত শুরুর অনুরোধ জানানো হয়। ফরেন্সিক-তদন্তের বিষয়বস্তু কী হবে, পুলিশ-কর্তৃপক্ষ তা-ও স্থির করে দিয়েছেন। সেগুলো কী?
লালবাজার-সূত্রের বক্তব্য: ১০ তারিখে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের তালা ভাঙা হয়েছিল, নাকি কেউ তালা খুলে দিয়েছিল, ফরেন্সিক-বিশেষজ্ঞেরা তা দেখবেন। ভাঙা হয়ে থাকলে যাচাই করা হবে, তা বাইরে থেকে ভাঙা হয়েছে কি না। পাশাপাশি পুলিশের দাবি: একমাত্র ফরেন্সিক-তদন্তে জানা সম্ভব, বেকার ল্যাবরেটরির কাচ ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের যন্ত্র কী ভাবে ভাঙা হয়েছিল। বেকার ল্যাবের বাইরে উদ্ধার হওয়া জ্যাভলিনে কোনও হাতের ছাপ রয়েছে কি না, ফরেন্সিককে তা-ও খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে বলে জানান লালবাজারের এক কর্তা।
প্রয়োজন হলে সাধারণত কোনও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে-পরেই ফরেন্সিকের সহায়তা চেয়ে থাকে পুলিশ। কারণ প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, রেশ টাটকা থাকতে ফরেন্সিক-তদন্ত শুরু হওয়া জরুরি, নচেৎ যথাযথ তথ্য-প্রমাণ হাতে আসা কঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রেসিডেন্সির ক্ষেত্রে ফরেন্সিক-তদন্ত শুরু হতে হতে চলতি সপ্তাহও গড়িয়ে যেতে পারে বলে সূত্রের ইঙ্গিত। স্বাভাবিক ভাবে তাই প্রশ্ন উঠছে, প্রায় দু’সপ্তাহ বাদে তদন্তে নেমে ফরেন্সিকের পক্ষে কী করা সম্ভব?
রাজ্য ফরেন্সিকের এক কর্তার দাবি, “তালা কী ভাবে ভাঙা হয়েছিল, কিংবা আদৌ ভাঙা হয়েছিল কি না, তা প্রমাণ করার মতো প্রযুক্তি আমাদের আছে। এমনকী আমরা এ-ও বার করতে পারি, বেকার ল্যাবের কাচ ভিতর থেকে ভাঙা হয়েছিল, নাকি বাইরে থেকে।” কিন্তু এখন ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রয়োজনীয় অন্যান্য নমুনা কি খুঁজে পাওয়া যাবে?
এক ফরেন্সিক-কর্তা বলেন, “প্রমাণ কেউ নষ্ট না করলে সমস্যা হবে না।” রাজ্য ফরেন্সিক ল্যাবের প্রাক্তন অধিকর্তা জিতেন্দ্রনাথ পালের কথায়, “ভাঙচুরের ঘটনায় কী দেখতে হবে, সব সময় নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। এক-একটা ঘটনায় তা এক-এক রকম। তবে বেশ কিছু স্থায়ী প্রমাণ থাকে। ভাঙচুরের চিহ্ন মেরামত করে না-ফেললে কিংবা ঘাঁটাঘাঁটি না করলে ৭-৮ দিন পরেও প্রমাণ মেলা সম্ভব।” কেন্দ্রীয় ফরেন্সিকের মুখ্য বিশেষজ্ঞ চন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অবশ্য জানাচ্ছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘটনাস্থলে যাওয়া যায়, তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। “যত দেরি হয়, সম্ভাবনা তত কমতে থাকে। সিবিআইয়ের নানা তদন্তে আমাদের কাছে অনেক দেরিতে আবেদন আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারি না।” আক্ষেপ চন্দ্রনাথবাবুর।
প্রশ্ন আরও রয়েছে। যেমন, প্রেসিডেন্সি-কাণ্ডে ফরেন্সিক-তদন্তের প্রয়োজন হল কেন? আর যদি হয়ই, তবে এত দিন পরে কেন?
কলকাতা পুলিশের এক কর্তার দাবি, অভিযোগ অন্য মাত্রা পাওয়ার ফলেই ফরেন্সিক-তদন্তের সিদ্ধান্ত। “প্রাথমিক তদন্তে আমাদের মনে হয়েছিল, বাইরে থেকে গেট ভেঙে দুষ্কৃতীরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকেছিল। আর তাদেরই কয়েক জন গিয়ে বেকার ল্যাবের কাচ ও ফিজিক্সের যন্ত্র ভাঙে। প্রেসিডেন্সির এফআইআরেও সে কথা বলা হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা একই বয়ান দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে বিভিন্ন মহল থেকে অন্তর্ঘাতের অভিযোগ তোলা হয়েছে। তার জেরেই ফরেন্সিক তদন্ত” ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তিনি। অর্ন্তঘাতের অভিযোগ বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে?
পুলিশ-কর্তার জবাব, “অভিযোগ উঠেছে, ভিতর থেকেই তালা খুলে দেওয়া হয়েছিল। এমনকী, জ্যাভলিনটি প্রেসিডেন্সিরই সম্পত্তি কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। তাই নিশ্চিত হতে ফরেন্সিককে ডাকা হয়েছে। আর নতুন অভিযোগ এসেছে অনেক দেরিতে। ফলে ফরেন্সিক ডাকতে দেরি হয়ে গিয়েছে।” কলকাতা পুলিশের একটি সূত্রের অবশ্য দাবি, ফরেন্সিক তদন্ত চাওয়া হয়েছে তিন দিন আগেই। যদিও ফরেন্সিক বিভাগ সূত্রে এই দাবির সমর্থন মেলেনি।
ঘটনা হল, যে সব অভিযোগের ভিত্তিতে লালবাজার ফরেন্সিক-তদন্তে উদ্যোগী হয়েছে, তার একটাও পুলিশের কাছে লিখিত ভাবে পেশ করা হয়নি। তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মুখে বিভিন্ন সময়ে ওই সব কথা শোনা গিয়েছে। কারও মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তদন্ত করতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। যার জবাবে লালবাজার-কর্তৃপক্ষের যুক্তি: মৌখিক অভিযোগ কে করছেন এবং তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা, তা যাচাই করে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া যেতেই পারে। এতে কোনও ভুল নেই।
নিজেদের সিদ্ধান্তের সমর্থনে যুক্তি দিলেও লালবাজারের কর্তাদেরই একাংশ আবার ফরেন্সিক-তদন্তের ‘সাফল্য’ সম্পর্কে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না। ওঁদের আশঙ্কা, বিশেষত জ্যাভলিনটি নানা জায়গায় নিয়ে গিয়ে সংবাদ মাধ্যম যে ভাবে ছবি তুলেছে, তাতে ফরেন্সিকের তেমন কিছু করার থাকবে না। উপরন্তু বুধবারের ঝড়-জল বিভিন্ন প্রমাণ ধুয়ে-মুছে ফরেন্সিকের কাজ আরও কঠিন করে দিয়েছে বলে লালবাজারের এই অংশের ধারণা।
|