|
|
|
|
শান্তির আবেদনেও বিরাম নেই বিবাদে |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
দিল্লি-কাণ্ডের জেরে উত্তরবঙ্গের জেলায় জেলায় তৃণমূল ও সিপিএম সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ অব্যাহত। দু’পক্ষের নেতারা শান্তি বজায় রাখার আবেদন করলেও বুধবার দিনভর উত্তরবঙ্গের নানা জায়গায় বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তৃণমূল ও সিপিএম কর্মী সমর্থকেরা। এমনকী, এ দিন সন্ধ্যায় শিলিগুড়িতে তৃণমূলের উপরে হামলায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় সিপিএম নেতা ও প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য ও সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকারকে।
এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুরে সিপিএমের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সম্পাদক মানবেশ চৌধুরী, প্রাক্তন মন্ত্রী নারায়ণ বিশ্বাস এবং জেলা ও রাজ্য নেত্রী মিনতি ঘোষকে নিগ্রহ করার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলে সমর্থকদের বিরুদ্ধে। নারায়ণবাবুর দাবি, হরিরামপুর এলাকার আরএসপির শ্রমিক সংগঠন ইউটিইউসির অফিস ভাঙচুর করা হয়। দুই কংগ্রেস সমর্থকের বাড়িও ভাঙচুর হয়। খবর পেয়ে বামফ্রন্টগত ভাবে ইউটিইউসির অফিসে গিয়ে বেরিয়ে আসছিলেন তাঁরা। তিনি বলেন, “বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একদল তৃণমূল কর্মী-সমর্থক আমাদের ঘিরে ধরে কিল, চড়, ঘুষি মেরে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় ফেলে দেয়।” দলের গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদক মিনতি ঘোষকে হামলাকারীরা নিগ্রহ করে বলে তিনি অভিযোগ করেন। |
|
শিলিগুড়িতে গণ্ডগোলে ঢিলের আঘাতে জখম এক ব্যক্তি। |
প্রথমে তাঁরা হরিরামপুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা করাতে যান। সেখান থেকে তাঁদের বালুরঘাট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালে মানবেশবাবু দাবি করেন, “হরিরামপুরের তৃণমূল নেতা সোনা পালের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে।” জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক সোনা পাল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “এ ধরনের হামলার কোনও ঘটনাই হয়নি। সিপিএম নেতারা মিথ্যা অভিযোগ তুলে দিল্লির ঘটনার ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে মারধরের নাটক করেছেন।” দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “এখনও পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ হয়নি। অভিযোগ পেলে ঘটনার তদন্ত করা হবে।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কাজল মণ্ডল দানিয়েছেন, মিনতিদেবীর ডান কাঁধে, মানবেশবাবুর মাথার ডান দিকে এবং নারায়ণবাবুর কোমরে আঘাত লেগেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। বাইরে থেকে আঘাতের চিহ্ন দেখা না গেলেও এক্স-রে করে তাঁদের চিকিৎসা হচ্ছে। কোচবিহারেও দলীয় কার্যালয়ে হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনা অব্যাহত। বামেদের কার্যালয় তো বটেই কংগ্রেস এবং বিজেপির একাধিক কার্যালয় ভাঙচুর হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে কোচবিহারে বুধবার বিকেল পর্যন্ত ১১৫টি দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুরের পাশাপাশি সে সব বিভিন্ন জায়গা থেকে টিভি চেয়ার-সহ বিভিন্ন সামগ্রী লুঠের অভিযোগ উঠেছে। বামেদের দাবি, জেলাজুড়ে সিপিএমের ৮৬টি এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের ২২টি কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে। তারমধ্যে কোচবিহার ১ ব্লকের কেটারহাট এলাকায় ফরওয়ার্ড ব্লকের একটি অফিসে ভাঙচুরের পর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য দীপক সরকার। |
উত্তেজিত সিপিএম সমর্থককে সামলাচ্ছে
পুলিশ। কোচবিহারে তৃণমূলের মিছিল।
বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র। |
দিল্লি-কাণ্ডের প্রতিবাদে জলপাইগুড়িতে
মিছিল তৃণমূলের। বুধবার জলপাইগুড়িতে
তোলা —নিজস্ব চিত্র। |
|
কংগ্রেসের পাঁচটি অফিস ও বিজেপির দু’টি অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। কর্মী-সমর্থকদের মারধর দোকান বন্ধ করে দেওয়া, লুঠপাট চালানোর মত নানা অভিযোগও উঠেছে। সবকিছুতেই তৃণমূলকে দায়ী করেছেন বাম, বিজেপি এবং কংগ্রেসের নেতারা।
সিপিএমের কোচবিহার জেলা সম্পাদক তারিণী রায় কোচবিহার জেলা হাসপাতালে ভর্তি। তিনি বলেন, ‘‘বুধবার নাটাবাড়ি দেওচড়াই, হাড়িভাঙা-সহ বেশ কিছু এলাকায় নতুন করে ভাঙচুর এবং লুঠপাট চালায় তৃণমূল সমর্থকরা। পুলিশ নির্বিকার বলেই এমন হচ্ছে। বামফ্রন্টগত ভাবে আলোচনা করে জেলায় প্রতিবাদ কর্মসূচি নেওয়া হবে।” পুন্ডিবাড়িতে সিটু নেতা পৃথীশ্ব বিশ্বাসকে এ দিন সকালে তৃণমূল সমর্থকরা মারধর করে বলে অভিযোগ। কোচবিহার জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্যামল চৌধুরী বলেন, ‘‘ঘুঘুমারি, লালবাজার, পাটছড়া, সিতাই, জিরানপুর মিলিয়ে আমাদের পাঁচটি দলীয় কার্যালয়ে তৃণমূল তাণ্ডব চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। পুলিশে অভিযোগ জানানো হচ্ছে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে ওরা।” বিজেপির অভিযোগ, জোড়াইয়ে দীপক বর্মন নামে তাদের এক সমর্থককে তৃণমূল মারধর করেছে। কোচবিহারের পুলিশ সুপার অনুপ জয়সওয়াল বলেন, ‘‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করে তদন্ত হচ্ছে।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, ‘‘সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। বামেদের উচিত দিল্লির ঘটনার জন্য মাথা মুড়িয়ে প্রায়শ্চিত্ত করা।” এ দিন জেলাজুড়ে ধিক্কার মিছিলও করে তৃণমূল। |
যা হল শিলিগুড়িতে |
বিকেল ৪টা |
হিলকার্ট, সেবক রোডে ধরে মিছিল বামেদের। এয়ারভিউ মোড়ে সভা। |
বিকাল ৫টা |
বাম নেতা-কর্মীরা সভা সেরে দলীয় অফিসে ফিরলেন। সেই সময়ে তৃণমূলের মিছিল হিলকার্ট রোডে। |
বিকেল সওয়া ৫টা |
সিপিএম অফিস থেকে ঢিল, বোতল ছোড়া হচ্ছে বলে অভিযোগে তাতল মিছিল। শুরু হল ইট, ঢিল বৃষ্টি। |
বিকেল সাড়ে ৫টা। |
প্রচুর পুলিশ থাকলেও ঢিল, ইট বৃষ্টির বিরাম নেই। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব মিছিলের সকলকে সেবক রোডে নিয়ে দাঁড়ালেন। পুলিশ কর্তাদের ফোন করে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। পুলিশ লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। |
বিকেল পৌনে ৬টা |
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী নেতা-কর্মীদের বুঝিয়ে জড়ো করে মিছিলের মুখ ঘুরিয়ে হাসমি চকের দিকে রওনা হলেন। |
সন্ধ্যা ৬টা |
হাসমি চকে তৃণমূলের মিটিং শুরু। |
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা |
সিপিএম অফিসের সামনে ঢিল পড়তেই থাকে। অফিস লাগোয়া তিনতলা থেকে জলের বোতল উড়ে আসে বলে অভিযোগ। |
সন্ধ্যা ৭টা ১৫ |
শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার ঘটনাস্থলে। |
সাড়ে ৭টা |
সিপিএম অফিসের নিচতলায় তল্লাশি চালিয়ে প্রথম দফায় ১০ জন গ্রেফতার। |
রাত ৮টা |
দ্বিতীয় দফায় সিপিএম পার্টি অফিসে পুলিশি হানা। ভিতর থেকে বার করে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য, ভারাপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার, পাঁচ কাউন্সিলর-সহ ৪৯ জন গ্রেফতার। |
রাত সাড়ে ৮টা |
থানায় বসে অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকারেরা রাজ্য বামফ্রন্টে চেয়ারম্যান বিমান বসুর, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলেন। বামফ্রন্টের ডাকে আজ, বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে ১২ ঘণ্টার বন্ধের ডাক। |
|
এ দিন সকালে ময়নাগুড়িতে মিছিল করে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। বিকেলে তৃণমূলের তরফে দোমহনি, চূড়াভান্ডার, রাখালের হাট, পানবাড়ি হাটে মিছিল করে দিল্লিতে অর্থমন্ত্রীর উপরে হামলার ঘটনার প্রতিবাদ জানায় তৃণমূল। মঙ্গলবার রাতে দলীয় দফতরে হামলার প্রতিবাদে সিপিএমের তরফে আজ মিছিল করার সিদ্ধান্ত হলেও উত্তেজনা এড়াতে আজ, বৃহস্পতিবার ওই মিছিল হবে। এ দিন দুপুরে ইসলামপুরে প্রতিবাদ মিছিল করে তৃণমূল। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ইসলামপুরের আরও একটি সিপিএম-এর দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। সিপিএম-এর অভিযোগ, কিছু দুষ্কৃতী লাঠি নিয়ে রামগঞ্জে তাদের দলীয় কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে। সিপিএমের ইসলামপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক স্বপন গুহনিয়োগী বলেন, “তৃণমূল এ সব করছে।” তৃণমূল অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। বুধবার মালদহ জেলা তৃণমূলের সমর্থকরা শহর জুড়ে বিক্ষোভ দেখান। দুপুর নাগাদ মহিলা তৃণমূলের জেলা সভানেত্রী ও তৃণমূল যুব কংগ্রেসের কাযর্কারী সভাপতি অনন্ত চক্রবর্তীর নেতৃত্বে জনা ৫০ সমর্থক কালীতলায় জেলা সিপিএম জেলা দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখায়। সিপিএম কর্মীরা অফিসের মেইন গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে ওই বিক্ষোভ চলে। যান পযর্টনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী। বিক্ষোভকারীদের সিপিএম অফিসের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে মন্ত্রী বলেন, “এটা ঠিক নয়। দলের সিদ্ধান্ত হয়েছে কোন পার্টি অফিসের সামনে কিংবা কোন রাজনৈতিক নেতার সামনে বিক্ষোভ দেখানো যাবে না। যখনই শুনেছি বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিয়েছি।” সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, “আমি সেই সময় কার্যালয়ে ছিলাম। দিল্লির ঘটনার পরে দলের রাজ্য নেতৃত্ব ঘটনার নিন্দা করেছেন। তারপরেও তৃণমূল কর্মী সমর্থকরা আমাদের পার্টি অফিসে ও আমাদের দলের নেতাদের উপর হামলা করছে। প্রতিবাদে ১৭ এপ্রিল মালদহ কেন্দ্রীয় সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে।”
|
পুরনো খবর: দিল্লির ঘটনার আঁচ ছড়াল উত্তরবঙ্গেও |
|
|
|
|
|