প্রবন্ধ ২...
বিহার: কেন বিশেষ গোত্রে স্বীকৃতির দাবি
লা চলে, বিহার সাবালক হয়েছে। এই রাজ্য নিয়ে আলোচনার চরিত্র বদলাচ্ছে। গত বছরের ৪ নভেম্বর এবং এ বছরের ১৭ মার্চ পটনা ও দিল্লিতে দুটি সমাবেশ হল, স্বাধীন ভারতে এত বড় সমাবেশ কমই হয়েছে। লক্ষণীয়, দুটি সমাবেশেরই মূল বিষয় ছিল রীতিমত অর্থনৈতিক: বিহারকে স্পেশাল ক্যাটেগরি স্টেটাস বা ‘বিশেষ গোত্রের রাজ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতেই এই দুই সম্মেলন। এটাও বলবার মতো ব্যাপার যে, দিল্লির সমাবেশে কেবল বিহার নয়, অন্য পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলির জন্যও এই একই স্বীকৃতির দাবি শোনা গেল। ২০১৩-১৪ সালের সাধারণ বাজেটে এবং তার আগে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেও (২০১২-১৩) এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিচার-বিবেচনা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এটা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।
বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যোজনা বরাদ্দ বণ্টনের জন্য ‘গ্যাডগিল সূত্র’ নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে তিনটি রাজ্যকে বিশেষ গোত্রে রাখা হয়েছিল। এখন আছে এগারোটি। তাদের মধ্যে সাতটি রাজ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের, বাকি চারটি হল সিকিম, উত্তরাখণ্ড, জম্মু ও কাশ্মীর এবং হিমাচল প্রদেশ। এই রাজ্যগুলি রাজস্ব নীতি এবং কেন্দ্রীয় উন্নয়ন বরাদ্দ বণ্টনের ক্ষেত্রে নানা বিশেষ সুবিধে পায়। এই বিষয়ে আমরা একটু পরে আলোচনা করব। তার আগে জেনে নেওয়া যাক, কীসের ভিত্তিতে স্থির করা হয়, একটি রাজ্য বিশেষ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হবে কি না? এ জন্য দু’ধরনের মাপকাঠি আছে। এক দিকে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের নির্ধারিত চারটি মাপকাঠি: (১) ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, (২) বিস্তীর্ণ দুর্গম অঞ্চল, (৩) সম্পদের অপ্রতুলতা ও বাজার থেকে দূরবর্তী হওয়া এবং (৪) অনুন্নত পরিকাঠামো; অন্য দিকে, যোজনা কমিশনের নির্ধারিত পাঁচটি মাপকাঠি: (১) পার্বত্য ও দুর্গম অঞ্চল, (২) জনসংখ্যার অত্যল্পতা, (৩) নিরাপত্তার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চল, (৪) অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামোগত অনগ্রসরতা এবং (৫) রাজ্য কোষাগারের বেহাল অবস্থা। যে দিক দিয়েই দেখা যাক না কেন, একমাত্র জনসংখ্যার অত্যল্পতা ছাড়া বিহারে সব ক’টি সমস্যাই বহাল।
দাবি। অধিকার সমাবেশ, রামলীলা ময়দান, দিল্লি, ১৭ মার্চ, ২০১৩। ছবি: রমাকান্ত কুশবহ
বিহারের দাবির অন্য যুক্তিও আছে। দীর্ঘ বঞ্চনার যুক্তি। প্রথমত, পঞ্চাশের দশকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি প্রবর্তিত মাসুল সমীকরণ নীতি বিহারের অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি করেছিল। কয়লা, লোহা এবং সিমেন্ট যাতে দেশের সর্বত্র একই দামে পাওয়া যায়, সেই উদ্দেশ্যে এই নীতি বলবৎ করা হয়েছিল। এতে দক্ষিণ এবং পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলির বিরাট সুবিধা হয়, মার খায় পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং বিহার। একটি হিসেব অনুসারে, কেবল ইস্পাতের মাসুল সমান করে দেওয়ার ফলেই বিহারের লোকসান হয়েছিল ১,১২,৮১২ কোটি টাকা। কোনও ভাবেই এই ক্ষতি পূরণ করার চেষ্টা হয়নি। সোজা কথায়, বিহারের মতো পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিল্পায়নের রসদ জুগিয়েছিল, কার্যত তাদের ভর্তুকি দিয়েছিল। লক্ষণীয়, সে সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বিনা প্রতিবাদে এই সর্বনাশা নীতি মেনে নিয়েছিলেন।
অন্য ভাবেও বিহার কেন্দ্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এই রাজ্য মাথাপিছু যোজনা বরাদ্দ এবং যোজনা-বহির্ভূত অনুদান পেয়েছে অত্যন্ত কম। খরা ও বন্যার মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের বিপুল ব্যয় হলেও সেই বাবদ কেন্দ্র যথেষ্ট টাকা দেয়নি। ইউ পি এ তাদের অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচিতে বিহারের জন্য একটি বিশেষ ‘প্যাকেজ’-এর প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় আসার পরে আর তা কার্যকর করেনি। ২০১০-১১ সালের বাজেটে কয়েকটি রাজ্যকে বিশেষ সাহায্য দেওয়া হয়, বিহার বঞ্চিত হয়। এই দীর্ঘ বঞ্চনার ক্ষতিপূরণ বিহারের প্রাপ্য।
বিশেষ গোত্রের রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলে কী ধরনের সুবিধে পাওয়া যায়। প্রথমত, এই ধরনের রাজ্যে উৎপাদন শুল্কের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়, যার ফলে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা সেখানে লগ্নি করতে উৎসাহী হন। বাজার-কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগ ছাড়া উন্নয়নের গতি বাড়ানো দুঃসাধ্য। বিহার তার একটা বড় দৃষ্টান্ত।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় যোজনা বরাদ্দের ৩০ শতাংশ বিশেষ রাজ্যগুলির জন্য আলাদা করা থাকে। এই রাজ্যগুলিকে কেন্দ্র যতটা যোজনা বরাদ্দ মঞ্জুর করে, তার নব্বই শতাংশই পাওয়া যায় অনুদান হিসেবে, ঋণের অনুপাত মাত্র দশ শতাংশ। দ্বাদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশের পরে এই নব্বই-দশ সূত্রটি কেন্দ্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্প এবং বিদেশি সাহায্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। সাধারণ ভাবে, কোনও বিদেশি সাহায্যে ঋণের যে অনুপাত থাকে, সেই সাহায্য যে রাজ্যের ভাগে পড়ে তাকেও সাহায্যের সেই অনুপাতই ঋণ হিসেবে নিতে হয়। আর, কেন্দ্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্পের ক্ষেত্রে ঋণের অনুপাত হয় ত্রিশ শতাংশ।
ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে, বিশেষ গোত্রের রাজ্যগুলিকে বিভিন্ন ভাবে বাড়তি সাহায্য দেওয়া হবে, যেমন, (১) সেচ, রাস্তা ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাড়তি বরাদ্দ, (২) প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় শতকরা নব্বই ভাগ কেন্দ্রীয় সাহায্য, (৩) যোজনাবহির্ভূত খাতে রাজস্ব-ঘাটতি পূরণের জন্য বিশেষ অর্থ এবং (৪) ‘গ্রিড’-এর মাধ্যমে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের জন্য বর্ধিত উৎসাহ। এই ধরনের প্রয়োজনভিত্তিক সাহায্য বিহারের মতো রাজ্যের জন্যও সমান জরুরি।
এক কথায় বলা চলে, এখনকার ব্যবস্থাই যদি চালু থাকে, তা হলে বিহারে বিনিয়োগের যথেষ্ট প্রসার ঘটবে না। এমনকী উন্নয়ন বরাদ্দ দ্বিগুণ করেও এই প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়। এই কারণেই বিহারকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া জরুরি।

পটনায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর সদস্য-সচিব


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.