প্রবন্ধ ১...
অন্তত একটু সুশাসন পেলে ভাল হত
ইন অমান্য আন্দোলনের বিষয়গত যৌক্তিকতা নিয়ে যা-ই বিতর্ক থাক, এ কথা অনস্বীকার্য যে অহিংস আন্দোলনের অধিকার যে কোনও সংগঠনের রয়েছে। এবং সেই আন্দোলন যাতে শেষ পর্যন্ত অনভিপ্রেত ঘটনাবিহীন থাকতে পারে, তার দায়িত্ব প্রশাসনের। সুদীপ্ত গুপ্তর মর্মান্তিক মৃত্যু কী ভাবে হল, তা অবশ্যই নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু একটি চাল টিপে যেমন ভাত সেদ্ধ হয়েছে কি না বোঝা যায়, তেমনই বোঝা গেল সাধারণ আন্দোলনের মোকাবিলায় কতটা অপ্রস্তুত এই সরকার। অথচ এই ঘটনাকে অনায়াসে ‘তুচ্ছ’ করলেন মুখ্যমন্ত্রী! গণতন্ত্রে অপরিহার্য সমালোচক, সংবাদমাধ্যম বা রাজনৈতিক বিরোধীদের প্রতি এমন মনোভাব কেন?
একটু তলিয়ে ভাবলে মনে হয় যে, বর্তমান শাসকেরা মোটেই সমালোচনা বা বিরোধিতা নিয়ে চিন্তিত নন। তাঁরা বস্তুত দাপট দেখাতে চাইছেন। ক্ষমতায় এসেই তাঁরা এই সিদ্ধান্তে স্থিত হয়েছেন যে, দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে হবে, অতএব বামফ্রন্টের কায়দায় ইস্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, এ-গলি ও-গলি সব দখল করে নাও। দু-একটা মুন্না বা শম্ভু কাউ-এর মতো বোকা লোক প্রথম দিকে ঝামেলা বাড়াবে, পরে সব সামলে নেওয়া যাবে। ‘কেন, ৩৪ বছরে এ রকম হয়নি?’ বিজন সেতু, বানতলা, আরও কী-সব যেন? আমরা তো এখনও নন্দীগ্রাম করিনি বস্!’ এই হচ্ছে টিপিক্যাল রি-অ্যাকশন। এই যে এক বার মাথায় ঢুকে গেল যে, শুধু দাপট দেখিয়ে, শুধু তড়পে দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখা যায়, তা-ও আজকের দিনে, তার থেকে শাসক দলের আর মুক্তি নেই।
অথচ ঘটনা হল, দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরে বামফ্রন্টের জনসমর্থন মোটেই এক রকম ছিল না। বস্তুত, ১৯৮৭ ও ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচন ব্যতিরেকে পশ্চিমবঙ্গে কখনওই ফ্রন্ট পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। জনসমর্থন ওঠানামা করেছে। সত্তরের দশকের নৈরাজ্য কাটিয়ে একটি স্থায়ী শাসনতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে ফ্রন্টকে নানা ঘটনাপরম্পরার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যখনই রাশ আলগা করা হয়েছে, তখনই নৈরাজ্যের উপাদানগুলিকে সক্রিয় হতে দেখা গেছে। ঘটে গেছে বানতলা বা বিজন সেতুর মতো নারকীয় ঘটনা। গার্ডেনরিচের পুলিশকর্মী নিহত হওয়ার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছে ডিসি পোর্ট বা তিলজলা থানার ওসির মর্মান্তিক মৃত্যু। কিন্তু এ সব কিছুর পরেও বামফ্রন্ট তার শক্তি বৃদ্ধি করেছে। ১৯৮৭-তে পেয়েছে সবচেয়ে বেশি ভোট। কেন?
জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার আপাত-নৈরাজ্যের আবহেও প্রথম দশ বছরে সেরে ফেলেছিল তিনটি এমন কাজ, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। প্রথমত, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ও শহরাঞ্চলে মিউনিসিপ্যালিটির কর্মবলয়ের প্রসার ঘটিয়ে নিয়মিত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা; দ্বিতীয়ত, সারা দেশে প্রথম সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমূল ভূমি-সংস্কার করা; এবং তৃতীয়ত, অতি সুনিপুণ ভাবে বামফ্রন্টের বন্ধুমণ্ডলীর বিস্তার ঘটানো। তৃতীয় কাজটিই সবার আগে হয়েছে। ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় আসার পরেই যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সরকার নেয়, তা হল রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি। এই বন্দিদের অধিকাংশই ছিলেন নকশালপন্থী। তাঁরা ক্ষুদ্র পরিসরে মানবাধিকার চর্চা বা বিপ্লবের আয়োজন চালিয়ে গেলেও কিছুতেই কংগ্রেস শাসন ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী ছিলেন না। এঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বাঙালি ভদ্রলোকেরা, যাঁদের আজকাল ‘বিদ্বজ্জন’ বলা হয়। তাঁরা অনেকেই বামফ্রন্ট আমলে ‘বন্ধুমণ্ডলী’র অঙ্গীভূত হয়ে বেশ এক প্রকার শৌখিন সমাজতন্ত্রে অবগাহন করেছেন।
ক্ষমতায় থাকতে থাকতে বামফ্রন্টের কলেবর ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক এস ইউ সি বাদে আর কোনও শরিক ছেড়ে যায়নি। ১৯৭৭-এ কংগ্রেস বন্ধু সিপিআই ১৯৮২-তে ভোল বদল করে বামফ্রন্টে। মরিচঝাঁপি কাণ্ডে বিক্ষুব্ধ বিধায়ক পরে স্থায়ী মন্ত্রিপদে আসীন। বাঙালিকে মাছ খাওয়ানোর দায়িত্ব তিনি কিছুতেই ছাড়েননি। সিপিআই-এম নাগাড়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। কিন্তু নিজস্ব আধিপত্য পরিহার না করেও শরিকদের ধরে রাখার, বন্ধুদের সংখ্যা বাড়ানোর একটা মরিয়া প্রচেষ্টা অব্যাহত থেকেছে। এতটাই যে, ক্ষমতা হারানো বাম নেতারা জনান্তিকে যা-ই বলুন না কেন, প্রকাশ্যে একে অপরের হাত ধরে আছেন।
আর মমতাদেবী? দু’বছরের মধ্যেই ‘অপূর্ব একা’। শুধু দল বা ‘বিদ্বজ্জন’ নয়, যে জনভিত্তি তিনি গড়ে তুলেছিলেন, তা-ও অপস্রিয়মাণ। বাম জমানার নেতিবাচক দিকগুলির অক্ষম অনুকরণের ফল এটাই। পাড়ায় পাড়ায় ‘সিন্ডিকেট’ চালাতেও একটা সবল সংগঠন লাগে, যা তৃণমূলের একেবারেই নেই। এখানে সবাই নেতা। তার ওপর তীব্র অসহিষ্ণুতা। কেউ সামান্য সমালোচনা করলেই মুহূর্তে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’। ফলে বন্ধুহীন হতে সময় লাগছে না শাসক দলের। বাম আমলে তৈরি হওয়া আইন দেখিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকেও ‘বামেদের ঘনিষ্ঠ’ বলতে বাধছে না।
বামফ্রন্ট নীতিগত স্তরে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল আমূল ভূমি-সংস্কারে। ব্যাপক বর্গা নথিভুক্তির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্রটাই পাল্টে গিয়েছিল। জমিকেন্দ্রিক অধিকারবোধ জন্ম দিয়েছিল এক স্থায়ী রাজনৈতিক জনভিত্তি। কৃষিক্ষেত্রে অবহেলিত পূর্ব-ভারতে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন এবং জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ভূমি-সংস্কার ভিন্ন অন্য কোনও সহজ পথ ছিল না। ভূমি-সংস্কার না হওয়া সত্ত্বেও দেশের উত্তর-পশ্চিমে কৃষি-মজুরি বেশি, তার কারণ ‘সবুজ বিপ্লব’। পূর্ব ভারতে ভূমি-সংস্কারই পারে সেই অধিকারবোধের জন্ম দিতে, যা গ্রামীণ জীবনে এক ধরনের সামাজিক সাম্য আনতে সক্ষম। এই সামাজিক সাম্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতিতেও রাজনৈতিক ফলপ্রদায়ী হয়।
আজ আর ওই জমি নীতি আঁকড়ে থাকার কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই, নতুন করে ভূমি-সংস্কারেরও সুযোগ নেই। জমির উপর অর্জিত অধিকারের প্রশ্নটিকে নাকচ না করেই এখন চাই নয়া শিল্পকেন্দ্রিক জমি নীতি। কাজটি ভূমি-সংস্কারের মতো একমাত্রিক নয়। এ কাজ কতটা জটিল তা সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার বুঝেছে। কিন্তু তা এড়িয়ে গিয়ে অর্থনীতির উন্নয়ন করা কার্যত অসম্ভব। শুধু শিল্পের প্রয়োজনেই নয়, আজ পশ্চিমবঙ্গে আবশ্যিক পরিকাঠামো প্রসারের জন্যও জমি নিতে সরকার অপারগ। এই পলায়নী মনোবৃত্তি আখেরে ফলপ্রদায়ী হবে না।
জনভিত্তি গড়ে তোলার যে সুস্পষ্ট নীতি বামফ্রন্ট নিয়েছিল, তা যেমন তাদের স্থায়িত্ব দিয়েছে, তেমনই দলবাজি, স্বজনপোষণ, পাড়ায় পাড়ায় ‘সিন্ডিকেট’-এর দাপাদাপি, হাওয়াই-চপ্পল-পরা ‘পুলিশ’-এর গোলাগুলি বামফ্রন্টের জনপ্রিয়তা হ্রাস করেছে। অথচ তৃণমূল সেই একই সহজিয়া পথের সাধক হয়ে উঠেছে। তৃণমূলের বন্ধুরা বলেছেন যে, বামফ্রন্ট নাকি শুধু ওই করেই ক্ষমতায় ছিল!
এই ‘উল্টা বুঝলি রাম’-এর বাতাবরণে সর্বশেষ সংযোজন পঞ্চায়েত নির্বাচন। বামপন্থীদের নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা ও পঞ্চায়েতের পুনর্গঠন দেশের মধ্যে নিদর্শনস্বরূপ। একই সঙ্গে এ কথা সত্য যে, তৃণমূলস্তরে দলীয় আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ‘রেড পঞ্চায়েত’গুলি গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের মূল নীতি থেকেই সরে এসেছিল। পঞ্চায়েত পুনর্গঠনের কাজ যদি তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে থাকে, তবে দলীয় আধিপত্য কায়েমের প্রচেষ্টা তা হ্রাস করেছে। অথচ কী আশ্চর্য, তৃণমূল কংগ্রেস সেই জনভিত্তি হ্রাস-এর উপাদানগুলিকেই প্রধান করে তুলছে! একটা সর্বগ্রাসী দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত। অথচ সবাই সব পারে না। তৃণমূলও বামফ্রন্ট হতে পারবে না। নিজের মতো করে একটি সুশাসন দেওয়ার যে অঙ্গীকার ছিল, তাও আজ অধরা।
মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি স্বামী বিবেকানন্দের নামে সবাইকে শপথ নিইয়েছেন। ভাল। বিবেকানন্দ স্বল্পায়ু ছিলেন, তবু একটি স্থায়ী ‘দাগ’ রেখে গেছেন। বর্তমান সরকার দীর্ঘায়ু না-ই হতে পারে, তবু সুযোগ আছে ‘দাগ’ রেখে যাওয়ার। স্বল্পকালীন সুশাসনের ‘দাগ’। কেবল ধমক দিয়ে, দাপট দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে উল্টো ফল হতে পারে। শুধুমাত্র দাপট দেখালে কী হয়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।

বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.