অসমের রেশম শিল্পীরা বেশ কিছু কাল যাবৎ ক্ষুব্ধ ভিন্ রাজ্য হইতে আমদানি করা রেশম বস্ত্রের সহিত প্রতিযোগিতায় তাঁহাদের স্থানীয় উৎপাদন মার খাইতেছে। তাঁহাদের দাবি ছিল, অন্য রাজ্য হইতে রেশম শাড়ি, বিশেষত বেনারসি, আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিতে হইবে। তাঁহাদের প্রতিবাদটি ক্রমেই হিংসাত্মক হইয়া উঠায় রাজ্য সরকার খানিক নড়িয়া বসিতে বাধ্য হইয়াছে। তবে সরকার নিষেধাজ্ঞা জারির পথে হাঁটে নাই, বেনারসি শাড়ির উপর দুই শতাংশ প্রবেশ কর আরোপ করিয়াছে। নিষেধাজ্ঞা এবং প্রবেশ কর উভয়ই বাধা, তবে ভিন্ন গোত্রের। প্রথমটি বাজার ব্যবস্থার বাহিরে, দ্বিতীয়টি বাজার প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। কোনও আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিবার অভ্যাসটি গত শতকের সমাজতান্ত্রিক ব্যাধি ছিল। এখন তাহা অতীতমাত্র। সেই অতীতের পথটি পরিহার করায় অসম সরকার ধন্যবাদার্হ।
তবে, সরকার যে পথে হাঁটিয়াছে, তাহাও বহু প্রাচীন। অষ্টাদশ শতকের শেষ দশকে মার্কিন রাজনীতিক আলেকজান্ডার হ্যামিলটন তাঁহার ‘রিপোর্ট অব ম্যানুফ্যাকচার্স’ গ্রন্থে প্রথম বলেন, কোনও রাষ্ট্রে (অসমের ক্ষেত্রে অবশ্য রাষ্ট্র নহে, একটি অঙ্গরাজ্য) যদি কোনও একটি শিল্প প্রাথমিক স্তরে থাকে, এবং তাহা যদি ভিন্ দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পের সহিত প্রতিযোগিতায় টিকিতে না পারে, তবে সেই রাষ্ট্র সেই নির্দিষ্ট শিল্পের পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করিতে পারে। অর্থনীতির পরিভাষায় এই যুক্তির নাম ‘ইনফ্যান্ট ইন্ডাস্ট্রি আর্গুমেন্ট’। প্রতিষ্ঠিত শিল্পে উৎপাদনের পরিমাণ যেহেতু বেশি, ফলে পণ্য উৎপাদনের গড় ব্যয় কম। যে শিল্প নূতন গড়িয়া উঠিতেছে, তাহার উৎপাদনের গড় ব্যয় তুলনায় অনেক বেশি। নূতন শিল্পের এই অসুবিধা দূর করিতেই সেই পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কর আরোপ করা হইয়া থাকে, যাহাতে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য স্ফীত হইয়া অভ্যন্তরীণ পণ্যের স্তরে উঠিয়া আসে। তবে, এই ব্যবস্থাটি চিরস্থায়ী নহে। নূতন শিল্পটি তাহার শৈশব পার করিলেই এই ব্যবস্থার বিলুপ্তি বিধেয়।
ভারতসহ বহু দেশের অভিজ্ঞতা বলিতেছে, বিদেশি শিল্পের বৃহদায়তনের সুবিধার মোকাবিলা করিতে ‘ইনফ্যান্ট ইন্ডাস্ট্রি আর্গুমেন্ট’ ব্যবহার করা হইলেও শেষ পর্যন্ত তাহা অভ্যন্তরীণ শিল্পের অকুশলতার ঢাল হইয়া দাঁড়ায়। প্রতিযোগিতার সম্মুখীন না হওয়ার নিশ্চয়তা থাকিলে দেশীয় শিল্পগুলি সাধারণত তাহাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াইবার প্রশ্নটিকে আর গুরুত্ব দিতে চায় না। সংশয় হয়, অসমে অবস্থাটি সে রকমই। অসমের রেশম শিল্প নূতন নহে। তাহার সমস্যা, শিল্পটি অকুশলী। ঘোর বাজারবাদীরা বলিবেন, অকুশলী শিল্পকে টিকাইয়া রাখিবার প্রয়োজন নাই। অসমে এখনই অতখানি কঠোর হওয়ার প্রয়োজন নাই। তবে এই নূতন সুবিধাটি যে জন্মজন্মান্তরের জন্য নহে, তাহা স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন। সময়সীমা বাঁধিয়া দেওয়া হউক। সেই সময়ের মধ্যে অসমের রেশম শিল্প কুশলী হইয়া উঠিতে পারিলে ভাল। না পারিলে, কর্মীদের নূতন পেশার সন্ধান করিতে হইবে। |