পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের হাত ধরিয়া রাস্তার রাজনীতি কলিকাতা হইতে দিল্লিতে গিয়া চড়াও হইয়াছে, ইহাতে আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়ের কিছু নাই। রাস্তা কলিকাতাতেও আছে, দিল্লিতেও আছে। বিস্ময় অন্যত্র। সি পি আই এম তথা তাহার অনুগামী এবং অনুগত এস এফ আই সম্পূর্ণ গায়ে পড়িয়া এমন আত্মঘাতী আচরণে প্রবৃত্ত হইল কেন? কথিত আছে, ঈশ্বর যাহার সর্বনাশ করিতে চাহেন, আগে তাহার বুদ্ধি কাড়িয়া লন। সর্বনাশের পরেও যে তিনি বুদ্ধি ফিরাইয়া দেন না, তাহা হয়তো তেমন ভাল করিয়া জানা ছিল না। ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁহার সহকর্মী ও অভিভাবকগণ সেই সত্য বুঝাইয়া দিলেন। আরও বুঝাইয়া দিলেন, তাঁহারা ঈশ্বরের সঙ্গ ছাড়িলেও ঈশ্বর তাঁহাদের সঙ্গ ছাড়েন নাই। রাজনীতির শুভাশুভ বা নৈতিকতা লইয়া আলোচনা নিষ্প্রয়োজন, নিছক রাজনৈতিক বাস্তববোধের যুক্তিতেই তাঁহাদের এই প্রকাশ্য অসভ্যতার ব্যাখ্যা পাওয়া ভার। আইনশৃঙ্খলার ক্রমিক অবনতি, দলবাজি ও স্বজনপোষণ এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন লইয়া কমিশনের সহিত কাজিয়া, তদুপরি আইন অমান্য আন্দোলনে এস এফ আইয়ের তরুণ সদস্য সুদীপ্ত গুপ্তের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে রাজ্যের শাসক দল কিঞ্চিৎ অস্বস্তি এবং অসুবিধায় ছিলেন। সেই ঘটনারই ‘প্রতিবাদ’ জানাইতে গিয়া এমন নিগ্রহকাণ্ড শাসক দলকে দম ফেলার অবকাশ দিয়াছে। এবং, এতদ্দ্বারা বামপন্থীরা কেবল নিজেদের মুখ পুড়াইলেন না, রাজনৈতিক পুঁজিও আরও অনেকখানি খোয়াইলেন। পঞ্চায়েত নির্বাচন যদি সত্যই অনুষ্ঠিত হয়, এই ঘটনা তাহাতে দলের মলিন সম্ভাবনাকে মলিনতর করিবে, এমন কথা মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। রাজনৈতিক বিচক্ষণতার নিরিখেও এই অপকাণ্ড অতএব আত্মঘাতী।
অথচ, এমন ঘটনা ঘটিয়া যাইবার পরেও দলের সম্বিৎ ফিরিবার কোনও লক্ষণ নাই। পলিটব্যুরোর তরফে এক বিলম্বিত বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দা করা হইলেও তাহার ‘তদন্ত’ করার কথা বলা হইয়াছে। রাজধানীর রাজপথে প্রকাশ্য গুন্ডামির তদন্ত? আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের রাজ্য দফতর হইতেও কিছু মৃদু আত্মসমালোচনার সুর শুনা গিয়াছে বটে, কিন্তু নিগ্রহ-লাঞ্ছনায় লিপ্ত দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয় নাই। এস এফ আই এবং সি পি আই এমের সূক্ষ্ম তফাতের গল্প শুনাইয়া কোনও লাভ নাই, এস এফ আই, ডি ওয়াই এফ, সিটু ইত্যাদি শাখা সংগঠনের সহিত সর্বশক্তিমান পার্টির সম্পর্ক কী ও কেমন, তাহা নাবালকেও জানে। প্রসঙ্গত, ঋতব্রতবাবু এস এফ আইয়ের প্রতিনিধি হিসাবে দক্ষিণ কলিকাতা কেন্দ্রে ভোটপ্রার্থী হন নাই। এই অপকর্মের পূর্ণ দায়িত্ব সি পি আই এমের। এমন একটি কুকীর্তিতে লিপ্ত কর্মীদের বহিষ্কার না করার অর্থ তাহাদের প্রশ্রয় দেওয়া। বামপন্থী নেতৃত্ব সম্ভবত ইহাকে তত নিন্দাযোগ্য ঘটনাই গণ্য করিতেছেন না। অথবা— আরও বেশি সম্ভব— তাঁহারা মনে করেন, এই রাস্তার রাজনীতিই তাঁহাদের স্বধর্ম, এবং স্বধর্মে নিধন শ্রেয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জাহানারা দেখিয়া শুনিয়া বলিতেন: আবার বলি, চমৎকার!
দিল্লির ঘটনায় মুখ পুড়াইবার অভিজ্ঞতায় সি পি আই এম অবশ্য একা নয়। মুখ পুড়িয়াছে দিল্লির প্রশাসন তথা পুলিশেরও। প্রথমত, এমন ঘটনা ঘটিল কী করিয়া? কলিকাতা হইতে আমদানিকৃত কতিপয় ‘তরুণ তুর্কি’ অল্প কিছু অনুচর লইয়া এমন ঘটনা ঘটাইতে পারিলেন, ইহা তো প্রায় বখতিয়ার খিলজির গৌড় জয়ের কথা মনে করাইয়া দেয়! কেহ কেহ বলার চেষ্টা করিয়াছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোজনা ভবনের সিংদরজায় সমবেত বিক্ষোভকারীদের এড়াইয়া অন্য পথে প্রবেশ করা উচিত ছিল, বিশেষত রাজধানীর প্রশাসন যখন সেই মর্মে তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াছিল। কিন্তু একটি রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী সরকারি কাজে যোজনা কমিশনে প্রবেশের জন্য খিড়কির দরজা ব্যবহার করিবেন কেন? তাঁহার নিরাপত্তা বিধানের সম্পূর্ণ দায় দিল্লির পুলিশ, তথা সরকারের। দ্বিতীয়ত, নিগ্রহকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা উচিত ছিল, টেলিভিশন চ্যানেলের সৌজন্যে তাহাদের শনাক্ত করিতেও কোনও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু পুলিশ ন যযৌ ন তস্থৌ। দিল্লি পুলিশ কি ইদানীং লালবাজারে শিক্ষানবিশি করিতেছে? |