|
|
|
|
দলের নালিশ ঋতব্রতর নামে |
দিল্লি নিরাপদ নয়, বলে এলেন মমতা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি ও কলকাতা |
যোজনা কমিশনের সামনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর হেনস্থার ঘটনায় দিল্লি পুলিশের উপরে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। একেবারে রাজধানীর কেন্দ্রে, সংসদ ভবন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে যোজনা কমিশনের সামনে কী ভাবে এক জন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে হেনস্থার মুখে পড়তে হল এবং আর এক প্রবীণ মন্ত্রীকে শারীরিক হেনস্থার শিকার হতে হল, তা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফেও এ বিষয়ে দিল্লি পুলিশের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। কেন যোজনা কমিশনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের সময় যথেষ্ট নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা।
দিল্লি পুলিশের তরফে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা আগেভাগেই রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের বিক্ষোভ নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তাতে কান দেননি। তাঁকে ভিআইপি গেট দিয়ে যোজনা কমিশনে আসার কথা বলা হয়। তখন প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে। তবু তিনি সেখানেই নেমে পড়েন। দিল্লি পুলিশের এক শীর্ষস্থানীয় কর্তা বলেন, “আমরা এই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছি। কিন্তু এটা শুধুই আমাদের গাফিলতি নয়। ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি সম্পর্কে আগেই পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনার এবং মুখ্যমন্ত্রীর প্রোটোকল অফিসারকে সতর্ক করা হয়েছিল।” স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককেও পুলিশের তরফে এই রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। গত কালের ঘটনায় যে এফআইআর করা হয়েছে, সেখানে নির্দিষ্ট করে কোনও বিক্ষোভকারী বা ছাত্র নেতার নাম নেই। অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সরকারি পদস্থ ব্যক্তিদের কাজে বাধা দেওয়া, শারীরিক আক্রমণ এবং গণ্ডগোল বাধানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে। এই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। |
 |
দিল্লি ছাড়ার আগে। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র |
সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, দলের কোনও নেতা-কর্মীকেও এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এ দিন অবশ্য এক আইনজীবী সরাসরি দিল্লির পুলিশ কমিশনারের কাছে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন যে, মমতাকে মারধর করেছেন ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। কাল মমতার সঙ্গে ছিলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনিও এ দিন বলেন, “ঋতব্রতর নেতৃত্বে এই পুরো ঘটনাটা ঘটেছে। উনি নিজেও শারীরিক ভাবে (মমতা ও অমিত মিত্রকে) হেনস্থা করেছেন।” খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এ দিন জানিয়েছেন, ঋতব্রত ও শতরূপ ঘোষ রাজ্যে ফিরলে তৃণমূল তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাবে। এ দিকে, ঋতব্রত ও শতরূপ ঘোষ দিল্লি বসেই হুমকি ফোন ও এসএমএস পাচ্ছেন বলে পাল্টা অভিযোগ। এমনকী, এ দিন সিপিএমের সদর দফতর একেজি ভবনের সামনে তৃণমূল বিক্ষোভ দেখাতে পারে, এই আশঙ্কায় সেখানে দ্বিস্তরীয় ব্যারিকেড মোতায়েন করা হয়।
এই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে যথেষ্ট অস্বস্তিতে দিল্লি পুলিশ। তাদের এক কর্তা আজ জানান, এটা যেন রাজনীতি বনাম পুলিশ হয়ে গিয়েছে। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ও মনে করছে, গত কাল যোজনা কমিশনের সামনে বিক্ষোভের সময় পুলিশ-কর্তাদের আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল। বিক্ষোভকারীদের একেবারে যোজনা কমিশনের গেট পর্যন্ত আসতে দেওয়াটাই পুলিশের উচিত হয়নি। নয়াদিল্লিতে কোনও রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের তরফে সংসদ ভবন অভিযান বা সংসদ ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেওয়া হলেও, সংসদের সীমানার বহু দূরে যন্তর মন্তরে বা পার্লামেন্ট স্ট্রিটে তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। ফলে দিল্লির নিরাপত্তা নিয়ে আজ প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন মমতা। তাৎপর্যপূর্ণ হল, পুলিশের সমালোচনা শোনা গেল সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের কাছ থেকেও। তিনি মনে করছেন, রাজ্যের মন্ত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশ যথেষ্ট সতর্ক ছিল না। তাঁর দলের ছাত্র সংগঠনের বিক্ষোভকারীরা কী ভাবে যোজনা কমিশনের দরজায় পৌঁছে গেল, সেটা দেখে তিনি নিজেই বিস্মিত! |
 |
রাজনীতি খুব নোংরা হয়ে গিয়েছে। ১৯৮৪-তে সাংসদ হওয়ার পর প্রায় ২৫ বছর দিল্লিতে কাটিয়েছি। মঙ্গলবার যা দেখলাম, তা অভূতপূর্ব। নিন্দার ভাষা নেই। আমি স্তম্ভিত। |
— মমতা |
|
প্রধানমন্ত্রী গত কালই মমতাকে ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন দিল্লির পুলিশ কমিশনার নীরজ কুমারও। আজ যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া বলেন, “মমতা গোটা ঘটনায় পরিণত মনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। উনি আমাদের শুধু জানিয়েছেন, প্রশাসনের আরও ভাল ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা উচিত ছিল।” আজ কলকাতা রওনা হওয়ার আগে মমতা বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, মমতাজি, যা হয়েছে, তার জন্য আমি দুঃখপ্রকাশ করছি। এমনটা হওয়া উচিত ছিল না। আমার মনে হয়, দিল্লিতে এমন ঘটনা এই প্রথম।” তিনি এ-ও বলেন, “আমি আবার দিল্লিতে আসব। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি, দিল্লি মোটেই নিরাপদ নয়।”
তবে পুলিশের আগাম সতর্কতা সত্ত্বেও তিনি যে ভিআইপি গেট দিয়ে যোজনা কমিশনে ঢুকতে চাননি, তা-ও স্বীকার করছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, “আমি নিজেকে ভিআইপি নয়, এলআইপি (লেস ইমপর্ট্যান্ট পার্সন) বলে মনে করি।” দিল্লি পুলিশ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অফিসারদের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পরই পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনার ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রোটোকল অফিসারকে জানিয়ে দেওয়া হয়, প্রধান ফটকে বিক্ষোভ চলছে। মুখ্যমন্ত্রী যেন ভিআইপি গেট ব্যবহার করেন। ওই গেটে কোনও বিক্ষোভকারী ছিলেন না। মুখ্যমন্ত্রীকে পুলিশের পাইলট গাড়ি নিতেও বলা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু আপ্ত-সহায়কের গাড়িতে গিয়ে প্রধান গেটের সামনেই নামেন। তাঁর গাড়িতে লালবাতি বা সরকারি চিহ্ন না থাকায় তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করাও মুশকিল ছিল বলে পুলিশের বক্তব্য। গাড়ি থেকে নেমে তিনি ভিড়ের মধ্যে হেঁটে ঢুকে পড়েন বলেও পুলিশের বক্তব্য। যোজনা কমিশনের কর্তারাও পুলিশের এই বক্তব্যকে সমর্থন করছেন। মমতা আজ পাল্টা অভিযোগ করেন, তিনি যখন গেটের সামনে পৌঁছন, সে সময় নিরাপত্তা-কর্মীরা গেটের তালা খুলতে চাননি। বলা হয়, চাবি নেই। তার পরে বলা হয়, গেট খোলার নির্দেশ নেই।
দিল্লির পুলিশ-কর্তাদের দাবি, যে হেতু বিক্ষোভকারীদের আটকাতে ওই গেটটি বন্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তাই তা খুলতে কিছুটা সময় লাগে। তত ক্ষণে হামলাকারীরা মমতাকে হেনস্থার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। মমতার পাশেই ছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কলকাতায় নেমে তিনি জানান, মমতার মাথা লক্ষ করে রড চালানো হলে তিনি সেটি ধরে নেন। ধাক্কায় টাল সামলাতে পারেননি সুব্রতবাবু। টাল খেয়ে পড়েন। কিল-ঘুসি তাঁর পিঠে পড়তে থাকে বলেও অভিযোগ করেন ফিরহাদ।
দিল্লি পুলিশ বলছে, এত কিছুর পরেও কিন্তু তারা মুখ্যমন্ত্রীর দেহরক্ষীর সাহায্যে তাঁকে যোজনা কমিশনের ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হয়। তাঁর শরীরেও কোনও আঘাত লাগেনি। অমিতবাবু অন্য দিকে চলে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তায় ব্যস্ত পুলিশ তাঁর দিকে নজর দিতে পারেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে দেওয়া রিপোর্টেও এই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যের অন্য মন্ত্রীদের পুলিশের নির্দেশ মানা উচিত ছিল। তা হলে এই ঘটনা এড়ানো যেত।
|
পুরনো খবর: রাজধানীতে এসএফআইয়ের হাতে নিগৃহীত অমিত মিত্র |
|
|
 |
|
|