নজর আড়াল করে দিয়েছিল গেটে
ঝোলা ছাত্রেরা, দাবি বাসচালকের
প্রেসিডেন্সি জেলের সামনে যে বাসটি থেকে এসএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্ত পড়ে গিয়েছিলেন, ঘটনার সময়ে তার গতি ছিল যথেষ্ট কম। শুধু তা-ই নয়, ঘটনার পূর্ব মুহূর্তে বাস কোনও ব্রেকও কষেনি বলে দাবি করেছেন চালক ও দুই কন্ডাক্টর।
এবং সে সময়ে বাসে কোনও পুলিশকর্মী ছিলেন কি না, তা-ও তাঁরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেননি। বস্তুত ওঁরা জানিয়েছেন, বাসের মধ্যে তখন কী হচ্ছিল, তা ওঁদের সে ভাবে নজরে আসেনি। তবে বাসের দু’টো দরজাতেই যে বেশ কিছু ছাত্র ঝুলছিলেন, লুকিং গ্লাস মারফত সেটা দেখা গিয়েছিল বলে চালক দাবি করেছেন। তাঁর বক্তব্য: সামনের দরজায় ঝুলন্ত ছাত্রদের ভিড়ে পিছনের দরজা আড়াল হয়ে গিয়েছিল, এমনকী বাসের বাঁ দিকে কতটা জায়গা আছে, তা-ও তিনি ঠাহর করতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, বাসের যাত্রাপথের বাঁ দিকেই ছিল সেই ল্যাম্পপোস্ট, যাতে সুদীপ্ত ধাক্কা খান। এবং তিনি পিছনের দরজা দিয়েই বাইরে পড়ে গিয়েছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
রাজু খান রতন কুমার জয়সোয়াল রাজা দাস
মঙ্গলবারের ঘটনার পরে পুলিশ বাসের চালক রাজা দাসের বিরুদ্ধে বেপরোয়া গাড়িচালনার অভিযোগ এনেছে। তিনি অবশ্য জামিন পেয়ে গিয়েছেন। রাজাবাবু এবং দুই কন্ডাক্টর রতন জয়সোয়াল ও রাজু খান শুক্রবার আনন্দবাজারকে বলেন, ঘটনার সময়ে বাসটি আদৌ বেপরোয়া ভাবে চলছিল না। তাঁদের বক্তব্য: প্রেসিডেন্সি জেলের কিছু আগে টালি নালার সেতু থেকে নেমে বাস কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরে বাসের ভিতরে থাকা এক দল ছাত্রের জোরাজুরিতে ফের চলতে থাকে। তখন দু’টো দরজায় বেশ কিছু ছাত্র ঝুলছিলেন বলে ওঁরা দাবি করেছেন। কী ভাবে ব্যাপারটা ঘটল?
ওঁরা জানাচ্ছেন, বাঁক নিয়ে প্রেসিডেন্সি জেলের কাছাকাছি পৌঁছতেই ‘পড়ে গেল পড়ে গেল’ চিৎকার শোনা যায়। চালক আবার বাস থামিয়ে দেন। রতনবাবু বলেন, “আমরা দুই কন্ডাক্টর আগাগোড়া ড্রাইভারের পিছনের সিটে বসে ছিলাম। ছেলেমেয়েরা ক্রমাগত চিৎকার করছিল। পিছনে কী হচ্ছে, তা আমরা দেখতে পাইনি। ওদের হাবভাব দেখে আমরা চুপ করে ছিলাম। শুধু ভাবছিলাম, কখন জেলে পৌঁছে সবাইকে নামিয়ে দেব।” চালক রাজার কথায়, “পিছনে কী চলছে, দেখতেই পাইনি। বাঁ দিকের লুকিং গ্লাসে শুধু দেখেছি, প্রথম গেটে অনেকে ঝুলছে। ওদের আড়ালে পিছনের গেট নজরেই আসছিল না।”
তিন বাসকর্মী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ থেকে বাস যখন ছাড়ে, তখন সেখানে জনা ৫০-৬০ ছাত্রছাত্রী ছিলেন। আর ছিলেন খাকি উর্দির দুই লাঠিধারী হোমগার্ড। “দু’জনই আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ব্রিজ পেরিয়ে বাস দাঁড়ানোর পর থেকে ওঁদের দেখিনি।” বলেন রতনবাবু। উল্লেখ্য, বাসে থাকা দুই হোমগার্ডের এক জন আব্বাস আলি বৃহস্পতিবার আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, সেতু পেরিয়ে বাস থামতে তাঁরা নেমে গিয়েছিলেন। বাস ছাড়ার পরে আর উঠতে পারেননি। প্রেসিডেন্সি জেলের মুখে ওই বাঁকের কাছে বাসের গতি কম ছিল বলে দাবি করেছেন আব্বাসও।
তা হলে পুলিশ চালকের বিরুদ্ধে বেপরোয়া বাসচালনার অভিযোগ আনল কেন?
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম এ দিন বলেন, “চালক বাঁক নেওয়ার সময়ে ল্যাম্পপোস্টটি খেয়াল না-করে বিপজ্জনক ভাবে তার কাছ ঘেঁষে এসেছিলেন। সম্ভবত তার ফলেই ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সুদীপ্তের মাথা পোস্টে ঠুকে যায়। এই কারণে চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।” অন্য দিকে চালক রাজাবাবুর প্রশ্ন, “ফার্স্ট গেটে ওরা যে ভাবে ঝুলছিল, তাতে বাঁক নেওয়ার পরে পিছনের গেটটা তো দেখতেই পাচ্ছিলাম না! বাঁয়ে কতটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে, সেটাই বা বুঝব কী করে?”ঠিক কী ভাবে সুদীপ্তের মাথা ল্যাম্পপোস্টে ঠুকে গেল, কী ভাবে তিনি মারা গেলেন, সে সম্পর্কে তাঁদের কোনও ধারণা নেই বলে জানিয়েছেন তিন বাস-কর্মী। পুলিশও এখনও জানাতে পারেনি, কী ভাবে ঘটনাটা ঘটল। প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে যুগ্ম কমিশনার (সদর) বলছেন, “আইন অমান্যকারীরা অপরাধী নন। তাই ওঁদের ধরে-বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় না। ওঁরা নিজেরাই বাসে দাঁড়িয়ে-বসে ইচ্ছেমতো স্লোগান দিতে দিতে যান। অনেকে বাসের ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে থাকেন। তবে সুদীপ্তের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তদন্ত শেষ হলেই তা বলা যাবে।”
সুদীপ্তর দেহ পড়ে থাকার জায়গার
নমুনা সংগ্রহ (মূলত শুকিয়ে যাওয়া
রক্তের নমুনাই নেওয়া হয়েছে)
বৃহস্পতিবার ফরেন্সিকের দল ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। তারা ল্যাম্পপোস্টটির উচ্চতা মেপেছে। বাসের পা-দানি থেকে পড়লে মাথা কোথায় ঠুকে যেতে পারে, তা যাচাই করেছে। ল্যাম্পপোস্টের সেই আনুমানিক জায়গায় গোল চিহ্ন দিয়ে সেখান থেকে ঘষে-ঘষে কিছু নমুনা নিয়েছে। যেখানে সুদীপ্তর দেহ পড়ে ছিল, নমুনা সংগ্রহ হয়েছে সেখান থেকেও। ফরেন্সিক-বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য জানিয়েছেন, ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কে এখনও তাঁরা প্রাথমিক কোনও ধারণা পাননি।
ময়না-তদন্তের রিপোর্ট (যা কলকাতা পুলিশ প্রকাশ করেছে) দেখেও বিষয়টি তাঁদের পরিষ্কার হয়নি। “বলা হয়েছে, মাথায় ভারী ও স্থির ভোঁতা বস্তুর আঘাত লেগেছিল। কিন্তু খুলির কোন দিকের হাড় কতটা ভেঙেছে, তা ওই রিপোর্টে নেই। সেটা না-জানলে ধারণা পাওয়া মুশকিল যে, আঘাত কোন দিকে লেগেছে।” মন্তব্য এক ফরেন্সিক-বিশেষজ্ঞের।
৫৯ রুটের ওই বাসটির (ডব্লিউবি ১১বি ২৭৮২) চালক-কন্ডাক্টরেরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার বকুলতলা থেকে যাত্রী নিয়ে দুপুর পৌনে একটায় তাঁরা ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেছিলেন।
স্ট্যান্ডে জনা বারো যাত্রী ওঠেন হাওড়া আসার জন্য। কিন্তু স্ট্যান্ড ছেড়ে একটু যেতেই পুলিশ বাসের দখল নেয়, নামিয়ে দেওয়া হয় যাত্রীদের। রাজাবাবুরা জানান, পুলিশ ওঁদের বলেছিল, আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়ার পরে বাস ছেড়ে দেওয়া হবে। রাজাবাবু বলেন, ধর্মতলা থেকে তিনি মেয়ো রোড ধরেছিলেন। মেয়ো রোডের মোড়ে আন্দোলনকারীরা জোর করে বাস থামান। সেখানে তাঁদের আরও কয়েক জন বাসে উঠে দু’গেটে ঝুলতে থাকেন।
দুই কন্ডাক্টর জানাচ্ছেন, ধৃতদের অনেকে গোড়া থেকেই বাসে ঝুলতে-ঝুলতে যাচ্ছিলেন। রাজা বলেছেন, মেয়ো রোড-ডাফরিন রোড-ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউ-হসপিটাল রোড-ডিএল খান রোড হয়ে তাঁরা প্রেসিডেন্সি জেলের সামনে পৌঁছান। “আগাগোড়া আস্তে চালাচ্ছিলাম। জোরে ব্রেকও কষিনি।” দাবি করছেন তিনি।
কিন্তু সেতু থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়েও ফের বাস ছাড়ল কেন?
কন্ডাক্টর রতনবাবু বলেন, “ছাত্রছাত্রীরা চিৎকার করে বলছিল, বাস জেলে ঢোকাতে হবে। আমরা ছিলাম অসহায়। রাজা তাই বাস চালিয়ে দেয়। তবে তাতে এমন কিছু ঝাঁকুনি লাগেনি যে, কেউ পড়ে যাবে!”
তিন বাসকর্মী জানিয়েছেন, ঘটনার পরে তাঁদের বাসসমেত হেস্টিংস থানায় নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। সেখানেই তাঁরা জানতে পারেন, জখম ছেলেটি মারা গিয়েছেন। সে দিন রাত আটটা নাগাদ চালককে জানানো হয়, যে হেতু তাঁর বাস থেকে পড়ে এক জনের মৃত্যু হয়েছে, তাই একটা ‘ছোট’ কেস দেওয়া হয়েছে। রাতটা ওঁকে থানায় কাটাতে হবে। দুই কন্ডাক্টরকে অবশ্য পুলিশ ছেড়ে দেয়।

ফরেন্সিক তদন্ত কেন
ঘটনাস্থলে মাংস-রক্ত-ঘিলু-চুল আছে কি না যাচাই
থাকলে সেগুলো কার বা কাদের খুঁজে বার করা
এতে জানা সম্ভব, ঘটনাস্থলে কে বা কারা ছিলেন
কী আঘাত থেকে দেহাংশ ওখানে পড়ে থাকল, তা জানা
এর থেকে ধারণা পাওয়া, কী ভাবে দুর্ঘটনা হয়েছে
কী দেখল ফরেন্সিক কী করল
ল্যাম্পপোস্টের উচ্চতা কত
বাসের পা-দানি থেকে পড়লে
পোস্টের কোথায় মাথা ঠোকা সম্ভব
পোস্টের সেই
আনুমানিক জায়গাটি চিহ্নিত
সেখান থেকে ঘষে ঘষে নমুনা সংগ্রহ

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.