মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আর রেলপথ নয়, হলদিয়া বন্দর থেকে সরাসরি জলপথে ফরাক্কায় যাবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা। সাগর থেকে যে সব জেলা ছুঁয়ে মুর্শিদাবাদে পৌঁছেছে ভাগীরথী, ইতিমধ্যে সেগুলির প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেছেন অন্তর্দেশীয় জলপথ পরিবহণ দফতরের অফিসারেরা।
জাতীয় তাপবিদ্যুৎ নিগম (এনটিপিসি) সূত্রে জানা যায়, তাদের ফরাক্কা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করবে জিন্দল আইটিএফ। ২০১১ সালের ১১ অগস্ট জিন্দল আইটিএফ এবং অন্তর্দেশীয় জলপথ পরিবহণ দফতরের সঙ্গে এনটিপিসি-র চুক্তি হয়। তাতে বলা হয়, জিন্দল গোষ্ঠী ইন্দোনেশিয়ার কয়লা সরবরাহ করবে। পরিবহণের দায়িত্ব সামলাবে জলপথ পরিবহণ দফতর (আইডব্লিউএআই)। ফরাক্কায় ২১০০ মেগাওয়েট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রতি বছর জলপথেই ৩.৩ মিলিয়ন টন কয়লা যাবে।
এনটিপিসি-র ফরাক্কার জনসংযোগ আধিকারিক শৈবাল ঘোষ বলেন, “হলদিয়া থেকে যে পথ ধরে রেলে কয়লা আসত, সেই পথে অনেক জায়গাতে সিঙ্গল লাইন রয়েছে। ওয়াগন সমস্যার জেরে হলদিয়া বন্দরে কয়লা পড়ে থাকত। সময় নষ্ট হত এবং সমস্যাও বাড়ত। জলপথে কয়লা আসতে শুরু করলে সেই সমস্যা আর থাকবে না।” ঠিক হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কয়লার জাহাজ হলদিয়া বন্দর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে ‘স্যান্ডহেড’ থেকে সরাসরি বেশ কয়েকটি বার্জে কয়লা নামানো হবে। সেগুলির পরিবহণ ক্ষমতা গড়ে ২১৫০ মেট্রিক টন। ওই সব বার্জ হলদি নদী থেকে হুগলি বা ভাগীরথী হয়ে ফরাক্কায় যাবে। ইতিমধ্যেই ফরাক্কা ফিডার ক্যানালের উপরে দু’টি জেটি বানানো হয়েছে। ক্রেন বসানোর কাজ চলছে। |
বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন... |
|
|
আইডব্লিউএআই সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে তারা কলকাতা থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত সমীক্ষা করেছে। তাতে দেখা গিয়েছে, ওই পথে বার্জ চলাচলে কোনও অসুবিধা নেই। কলকাতা বন্দর থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত ১৫টি সেতু রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম উচ্চতার সেতুটি রয়েছে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে, জলতল থেকে যার উচ্চতা ১০.৬ মিটার। বার্জের উচ্চতা ৭ মিটার। ফলে, কোনও সেতুতেই তা আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বার্জগুলি গড়ে ৭০ মিটার লম্বা, ২০ মিটার চওড়া। ফরাক্কা পর্যন্ত ভাগীরথীর গভীরতা ন্যূনতম ২.৫ মিটার, যা বছরে ৩৩০ দিন থাকেই। সারা বছরই বিস্তার থাকে অন্তত ৪৫ মিটার। ফলে বার্জ চলাচলে কোনও বিপত্তির কারণ নেই।
রেলের তুলনায় বার্জে কয়লা পরিবহণে সুবিধা একাধিক। প্রথমত, সময় বাঁচানো। শৈবালবাবু জানান, আগে ইন্দোনেশিয়ার কয়লা ওড়িশার পারাদ্বীপে আসত। সেখান থেকে হলদিয়া। কম নাব্যতার কারণে হলদিয়া বন্দরে সমস্যা লেগেই থাকে। প্রায়ই বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। যদিও বা বেশি জল থাকা অবস্থায় জাহাজ এনে মাল খালাস করা হত, রেলের ওয়াগন পাওয়ার সমস্যা থাকায় বন্দরেই পড়ে থাকত কয়লা। এখন জাহাজ বন্দরে না ঢোকায় সেই জটিলতা থাকবে না। শৈবালবাবু বলেন, “আগে কয়লার অভাবে ইউনিট বসে থাকত। জলপথ ব্যবহার করায় সময় বাঁচবে।”
দ্বিতীয়ত, খরচও কমবে। আইডব্লিউএআই জানায়, এক অশ্বশক্তির ইঞ্জিন যেখানে সড়কপথে ১৫০ কিলোগ্রাম এবং রেলপথে ৫৫০ কিলোগ্রাম বহনে সক্ষম, জলপথে তা ৪০০০ কিলোগ্রাম পণ্য পরিবহণ করতে পারে। রেলের তুলনায় প্রতি মেট্রিক টনে ৩১ শতাংশ কম খরচ হয়। দফতরের অধিকর্তা এস ভি কে রেড্ডি বলেন, “আমরা সমীক্ষা করে দেখেছি, জলপথ পরিবহণের ফলে আর্থিক দিক থেকে লাভবান হবে ওই সংস্থা। ট্রাফিক সমস্যাও থাকবে না।” হলদিয়া, কলকাতা, ত্রিবেণী, স্বরূপগঞ্জ, কুমোরপুর, নাসিরপুর ও ফরাক্কায় ‘বেস স্টেশন’ তৈরি করা হচ্ছে বলেও দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে।
ইতিমধ্যে নদীর উপরে নির্ভরশীল স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন আইডব্লিউএআই কর্তারা। মৎস্যজীবী, ফেরিঘাটের ইজারাদার, মাঝিদের সঙ্গেও বৈঠক করা হয়েছে। তাঁদের জানানো হয়েছে, বার্জ যাওয়ার সময়ে সাইরেন বাজানো হবে। তা শুনে সবাই সতর্ক হয়ে যেতে পারবেন। দফতরের নোডাল অফিসার অনিলকুমার বলেন, “এই সব বিষয় নিয়ে আমরা প্রতিটা জেলায় বৈঠক করছি।” শৈবালবাবু বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য সফল হলে একটি বিকল্প পথ খুলে যাবে। তখন শুধু কয়লা নয়, সিমেন্ট বা পাথরও জলপথে আনা যাবে।” |