রাজ্যপালের পরামর্শও ওড়াল অনড় সরকার
রাজ্যপালের পরামর্শে কান দিল না সরকার। আর শাসক দল তাঁকে সরাসরি আক্রমণই করে বসল। যার ফলে সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মধ্যে দ্বন্দ্ব মেটাতে যে মধ্যস্থের কাজ করছিলেন তিনি, তার আর কোনও অর্থই রইল না। দিনের শেষে নিজেদের পুরনো অবস্থানে অটল থেকে রাজ্য জানিয়ে দিল, আইনি অধিকার প্রয়োগ করেই তারা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে। কমিশন আজ, শনিবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২৬ এবং ৩০ এপ্রিল ভোটের ব্যবস্থা করুক। রাজ্য নির্বাচন কমিশন আবার তাতে রাজি নয়। উল্টে, এমন অচলাবস্থায় কী করণীয়, তা জানতে শুক্রবার দিনভর আইনি পরামর্শ করেছে তারা। কমিশনের এক মুখপাত্র স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যপালের পরামর্শ না মেনে সরকার যে ভাবে একরোখা মনোভাব দেখাল, তাতে এখন কমিশনের আদালতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
সব মিলিয়ে, এখন কোর্টের পথেই বল গড়াতে দেখছেন রাজ্য রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরা। নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে অবশ্য বলেছেন, “আমরা রাজ্য সরকারের চিঠির অপেক্ষায় আছি।” তবে রাজ্য সরকার আর কোনও চিঠি দেবে কি না, তা এখনও ঠিক হয়নি।
শুক্রবারও সারা দিন ছিল যথেষ্ট নাটকীয়। এ দিন বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যখন রাজভবনে যান, তখনও কেউ কেউ সমঝোতার ক্ষীণ আশা দেখছেন। কারণ রাজ্যপালের মধ্যস্থতা। সুব্রতবাবুর সঙ্গে ছিলেন পঞ্চায়েত সচিব সৌরভ দাসও। সুব্রতবাবুকে রাজ্যপাল বলেন, সুষ্ঠু ভাবে ভোট-পর্ব মিটে গেলে তো সরকারের কৃতিত্বই প্রমাণিত হবে। তাই অযথা জটিলতা এড়িয়ে দেখুন যাতে সময়ের মধ্যেই ভোট শেষ করা যায়।
নারায়ণন আরও জানান, আইন-শৃঙ্খলার যা পরিস্থিতি, তাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে কমিশন উচিত কাজই করেছে। সরকার তা মেনে নিলেই ভাল করবে। বাহিনী পাওয়া না গেলে রাজ্যের সশস্ত্র পুলিশ এবং ভিন রাজ্যের পুলিশ দিয়ে কাজ চালানো যায়। দরকারে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিষয়টি নিয়ে তিনি নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও মন্ত্রীকে জানান নারায়ণন। আরও বলেন, রাজ্য পুলিশের যা সংখ্যা, তাতে তিন দফায় ভোট না করলে প্রতি বুথে সশস্ত্র পুলিশ দেওয়া যাবে না। তাই সরকার প্রতি বুথে দু’জন করে পুলিশ দিয়ে তিন দফায় ভোট করানোর প্রস্তাব দিক। কমিশন যাতে এই প্রস্তাব মেনে নেয়, তা নিয়ে তিনি উদ্যোগী হবেন বলেও সুব্রতকে জানান রাজ্যপাল।
রাজভবন সূত্রের খবর, রাজ্যপালের প্রস্তাবে অরাজি ছিলেন না সুব্রতবাবু। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ না করে যে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না, এ কথা জানিয়ে তখনকার মতো রাজভবন ছাড়েন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। ৪৫ মিনিট বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “বিজ্ঞপ্তি জারি করার পরে কিছু জেলাকে আমরা নতুন করে বিন্যাস করেছি। আবার আমাদের নতুন করে বিজ্ঞপ্তি করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এখনও বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি। ছুটির মধ্যে সহমত হয়ে যদি কমিশন বিজ্ঞপ্তি জারি করে, তা হলে ২৬ এপ্রিল নির্বাচন করা সম্ভব। না হলে ২৬ এপ্রিল ভোট করা সম্ভব নয়।” রাজ্যপালের সঙ্গে আলোচনায় যে তিনি খুশি, সে কথাও তখন জানিয়ে দেন সুব্রতবাবু।
যদিও কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রসঙ্গে তখনও সরকারের পুরনো অবস্থানের কথাই জানান মন্ত্রী। বলেন, “৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইলেই পাওয়া যাবে, এর কোনও গ্যারান্টি নেই। কোনও রাজ্যে কখনও কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে, এমন নজির নেই। কমিশনকে মাথায় রাখতে হবে, আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। আমরা শান্তিতে ভোট করতে চাই। অনেক সুযোগ দিয়েছি নির্বাচন কমিশনকে।” একই সঙ্গে কমিশনের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে সুব্রতর বক্তব্য, “ফেব্রুয়ারিতে ভোট করতে বলেছিলাম। প্রথমে এক দফায় ভোট চেয়েছিলাম। তার পরে দু’দফায়। কিন্তু কমিশন কিছুই মানেনি। ওরা ২০০ কোটি টাকা চেয়েছিল, তার মধ্যে ১০০ কোটি টাকা দিয়েছি। আমরা সব সময়েই চাই ভোট হোক। কমিশন যে চিঠি দিচ্ছে তার সব বিষয়ের সঙ্গে আমরা একমত নই।”
এর পরেই সুব্রতবাবু মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি গিয়ে তাঁকে রাজ্যপালের বিকল্প প্রস্তাব সম্পর্কে জানান। তৃণমূল সূত্রের খবর, কিন্তু আরও এক দফা ভোটের দিন বাড়াতে রাজি হননি মমতা। তিনি পঞ্চায়েতমন্ত্রীকে জানান, যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেই মতোই ভোট হবে। মমতার বক্তব্য ছিল, রাজ্যপাল চাইলেই কি তিন দফায় ভোট মানতে হবে! বরং রাজ্যপালের অতি-সক্রিয়তায় বেজায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী দলের সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সরকারের পুরনো অবস্থান জানিয়ে দিতে বলেন। নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্যপালের অতিসক্রিয়তা নিয়েও সরব হতে বলেন। নেত্রীর নির্দেশে মুকুলবাবুও নজিরবিহীন ভাবে রাজ্যপাল এবং কমিশনকে আক্রমণ করেন। তাঁর কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়, দু’দফার ভোট থেকে সরতে নারাজ রাজ্য। এই সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যপাল ও কমিশনের এক্তিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মুকুলবাবু।
শাসকদলের প্রতিক্রিয়া দেখে রাজ্যপাল আর এ বিষয়ে পরামর্শ দেবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে প্রশাসনিক মহলের একটি বড় অংশ। এ দিন বিকেলে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়কেও রাজভবনে ডেকে পাঠানো হয়। রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা হয়। সম্ভাব্য আইনি জটিলতা নিয়ে তাঁরা কথা বলেন। বৈঠক শেষে বিমলবাবু জানান, যে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তার আইনগত অবস্থান কী এটাই তিনি রাজ্যপালকে ব্যাখ্যা করেছেন। যে সব কারণে সরকার ও কমিশনের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়েছে, তাতে আইনি অবস্থান কার দিকে কতটা শক্তিশালী, তার ব্যাখ্যাও তিনি দেন রাজ্যপালকে। পরে বিমলবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি বিস্তারিত কিছু বলতে পারব না। শুধু এটুকু বলতে পারি যে, আদালতের দ্বারস্থ না হয়ে সংঘাত মেটানোর পরামর্শই দিয়েছি আমি। রাজ্য সরকারকেও আগে একই পরামর্শ দিয়েছি।” অর্থাৎ, বিমলবাবুর কথায়, আলোচনার মাধ্যমেই এই সংঘাতের সমাপ্তি হওয়া ভাল। একই সঙ্গে অ্যাডভোকেট জেনারেল মনে করেন, এই বিষয় নিয়ে কোনও পক্ষেরই আইনি পথে হাঁটা উচিত হবে না।
তবে রাজভবনের প্রস্তাব মহাকরণ উড়িয়ে দেওয়ায় লড়াই এখন আদালতের দিকেই গড়াচ্ছে বলে ধারণা অনেকের। অন্তত কমিশনের তৎপরতা সে রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার থেকেই নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে আইনজীবী সমরাদিত্য পালের সঙ্গে আইনি পরামর্শ করছেন। শুক্রবার দু’তরফের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। কমিশন সূত্রের খবর, আইনগত দিকগুলি খতিয়ে দেখা সঙ্গে রাজ্যের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে কমিশন। এই দীর্ঘ বৈঠক তারই উদাহরণ।

রাজ্যপালের ভূমিকা
২৪৩ কে ধারায় যা আছে
উপধারা ১) পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা তৈরি থেকে ভোট পরিচালনা পর্যন্ত যাবতীয় কাজের কর্তৃত্ব, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার শুধু রাজ্য নির্বাচন কমিশনের।
উপধারা ২) কমিশনার কী কাজ করবেন, তাঁর মেয়াদ কত দিন বিধানসভা আইন করে তা ঠিক করবে। হাইকোর্টের বিচারপতিকে অপসারণ করতে গেলে যে পদ্ধতি নেওয়া হয়, কমিশনারকে সরাতেও একই পথ নিতে হবে।
উপধারা ৩) কমিশন চাইলে ১ নম্বর উপধারা মেনে সুষ্ঠু ভাবে পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনার জন্য সমস্ত ধরনের কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে সরকারকে নির্দেশ দেবেন রাজ্যপাল।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ
(কৃষ্ণ সিংহ তোমর বনাম আমদাবাদ পুরসভা মামলায় (২০০৬)
সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ের অংশবিশেষ)
২৪৩ কে (৩) ধারাতেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ওই ধারা অনুযায়ী, রাজ্যপালকে কমিশনের উপরে ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী সরবরাহ করতে হবে। ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিশনকে সব ধরনের সাহায্য করতে রাজ্য বাধ্য। অবাধ ও মুক্ত নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন, তা নিয়ে কমিশনের মতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মুকুল রায় যা বলেছেন
• রাজ্যপাল সাংবিধানিক প্রধান। সংবিধানে কার কী ভূমিকা, তা ২৪৩ কে ধারায় বলা হয়েছে। সেই ধারা অনুযায়ী রাজ্যপালের কাছে গিয়ে কমিশন বলতে পারে, পঞ্চায়েত ভোটে কত কর্মী লাগবে। তার বাইরে রাজ্যপালের কোনও ভূমিকা নেই।
• সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে কোনও বিষয়ে তাদের রায় দেয়। সংবিধান এবং সুপ্রিম কোর্ট এক নয়। সংবিধান কী বলছে, সেটাই আমরা অনুসরণ করব।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.