ক্লাসে ঢুকে মাঝে মধ্যেই ধাঁধায় পড়ে যান শিক্ষকেরা, ভুল করলাম না তো!
হু হু করছে ক্লাস, ছাত্রছাত্রী কোথায়! বগলে রোল-কলের খাতাটা নিয়ে বেবাক বোকা বনে ফের কমন রুমে ফিরে যাওয়া ছাড়া তাঁর আর উপায় কী?
কখনও বা ভাগ্যক্রমে এক-দু’জন।
—সে কিরে, বাকিরা কোথায়?
চেনা উত্তর, জানি না স্যার।
ক্লাস করতে বেজায় অনীহা ছেলেমেয়েদের। কলেজ-ছুট সেই সব ছেলে-মেয়েদের ক্লাসে ফেরাতে তাই এ বার ছাতা বগলে তিনি নিজেই নেমে পড়েছেন রাস্তায়। মানে, ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে, বাবা-বাছা করে তাঁদের ক্লাসে ফেরাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি। বলছেন, “ওঁদের দোষ দি-ই কী করে? নিশ্চয় আমাদের কোনও ভুল থাকছে। না হলে ওরা ক্লাসে আসছে না কেন!”
তিনি চাপড়া বাঙালঝি কলেজের অধ্যক্ষ কৃষ্ণগোপাল রায়।
দ্বিতীয়বর্ষে একটি বিষয়ে অনার্সে উপস্থিতির হার বড্ড কম, ছাত্রছাত্রীর তালিকা নিয়ে দুই সহকর্মী-সহ তিনি ছুটলেন সীমান্তের গ্রাম হাটখোলায়। কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে সটান চলে গেলেন ছেলে মেয়েদের বাড়ি। কখনও বা দুর্ঘটনায় পা ভেঙে বাড়িতে পড়ে থাকা ছাত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিচ্ছেন, “আমরাই বাড়িতে বসে ফর্ম ফিলাপ করে নিয়ে যাবো। চিন্তা করিস না। পরীক্ষা দিতে পারবি।” |
২০০১ সালে নদিয়ার বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন চাপড়ায় মাত্র ১৯টি ছাত্রছাত্রী নিয়ে শুরু হয়েছিল ওই কলেজ। বছর বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। কিন্তু বছর কয়েক ধরে আচমকাই কলেজে ছেলেমেয়েদের উপস্থিতির হার অস্বাভাবিক হারে পড়তে থাকে। নোটিশ জারি করেন কৃষ্ণবাবু। লাভ হয়নি। পড়বে কে? তাদের বাবা-মাকে কলেজে ডেকে পাঠিয়েও ফল পাননি। শেষতক নিজেই বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। কৃষ্ণগোপালবাবু বলেন, “ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম ভাল ভাল ছেলেমেয়েরা ক্লাসে আসা কমিয়ে দিচ্ছে। অথচ এরা যদি নিয়মিত ক্লাসে আসে, তাহলে রেজাল্ট ভাল হবে। ছেলেমেয়েরা কলেজে আসছে না কেন, তার খোঁজ করব না। ওরা তো আমারই ছেলে মেয়ের মতো।”
গ্রামেরই মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী সুকুলি খাতুন স্কুল থেকে ফেরার পথে বিএসএফ-এর গুলিতে মারা গিয়েছিল। সেই বিএসএফ-এর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে খুঁজতে খুঁজতে কৃষ্ণবাবু এক দিন হাজির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর শেখের বাড়ি। উঠোনে অধ্যক্ষকে দেখে চমকে যায় মিজানুর। কৃষ্ণগোপালবাবু জিজ্ঞাসা করেন, “নিয়মিত ক্লাস করছিস না। কী ব্যাপার রে?” মিজানুর উত্তর দেওয়ার আগে বাবা এগিয়ে আসেন। হাত কচলে বাবা বলেন, “সংসারে খুব অভাব। মিজানুর মাঠে মুনিশ না খাটলে সংসারটা চলবে কী করে।” এমনই হাজারো মিজানুর তাঁদের অভাব অভিযোগের কথাও এখন মন খুলে বলছেন অধ্যক্ষকে। তাঁদের কথা শুনে কলেজে অনেকের ফিজও মকুব করেছেন তিনি। কৃষ্ণগোপালবাবু বলেন, “ওদের সমস্যাগগুলো ওঁদের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা না বললে তো বুঝব না। তাই ঘুরছি। সমস্যা যতটা সম্ভব মেটানোর চেষ্টা করছি। অনেকে কলেজে ফিরছেও।” তিনি জানান, ছাত্রদের বাড়ি-ঘুরে এখন পর্যন্ত তাঁদের কলেজ-ছুটের তিনটি কারণ জানতে পেরেছেন তিনি— দারিদ্র, গৃশিক্ষকের কাছে পড়েই ‘স্টেজে’ মেরে দেওয়ার প্রবণতা আর অবশ্যই উঠতি বয়সের ফাঁকি মারার মেজাজ। তিনি বলেন, “এদের এই অনীহাটাই দূর করার চেষ্টা করছি। যাঁরা নিছক অভাবের কারণে আসতে পারছে না তাদের অন্যভাবে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।” |