অঞ্জন-ব্যঞ্জন
স্বপ্নে কচিপাঁঠা, টেবলে স্যালাড-শশা
বাঙালি ইদানীং বেশ স্বাস্থ্যলোভী। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা জিম, কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে। আর তার সঙ্গে ডায়েটিং-এর কৃচ্ছ্রসাধন। যা চিরকেলে ঝোলে-ঝালে-অম্বলে বাঙালি চরিত্রের থেকে অনেকটাই আলাদা। কোলেস্টেরল, ইউরিক অ্যাসিড, ব্লাড সুগারের ত্রহ্যস্পর্শে রসনারসিক বাঙালির জীবনে নেমে এসেছে ডায়েটিং-এর খাঁড়া। আর এখানেই দু’ভাগ, পেটুক বনাম পেটরোগা বাঙালি। কোন পাতে যে চলি?
আমার এক বাল্যবন্ধুর এ বিষয়ে স্পষ্ট মত। সেটা কী রকম? না, রেড মিট ছোঁবো না, চিকেন কষা হলে আছি। নো আলু, কিন্তু বেকড পোট্যাটো চিপসে দোষ নেই। অর্থাৎ, শক্তিদা মানে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই অমর পংক্তি, ‘ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি,’ যুগ যুগ জিও! আমারও এক বার শখ হয়েছিল যে শুধু স্যালাড খেয়ে থাকব, সঙ্গে ফ্রুট জুস। ব্যাপারটা শেষমেশ এমন দাঁড়াল যে স্যালাডটা হয়ে গেল সাইড ডিশ, সঙ্গে চলতে থাকল ফুল কোর্স চিকেন বিরিয়ানি। ভীষ্মের প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হয়ে গেল মাঝপথেই।
তবে, সব উদাহরণ-ই বিচ্যুতির নয়। কিছু সাত্ত্বিক ডায়েটাচারীকেও আমি চিনি, যাঁরা সতত নিষ্ঠাবান তাঁদের আহারে ও আচারে। মুশকিল হল, তাঁদের প্রতিজ্ঞা রাখতে গিয়ে স্বাভাবিকাহারী মানুষকে অনেক সময়ে বেজায় ঝামেলার মুখে পড়তে হয়। এক জনকে জানি, যিনি সন্ধেবেলা কারও বাড়ি গিয়ে যদি মুড়ি আর শশা না পান, তা হলেই মেজাজ সপ্তমে। আর এক জনের চায়ে চিনি পড়ে যাওয়াতে তাঁর মুখ-চোখের ভাবে তীব্র বিষক্রিয়া। এক জনকে তো শুনেছিলাম তিনি নাকি বাড়ির ছাদে উচ্ছের চাষ শুরু করেছিলেন বাজারের পেস্টিসাইড দেওয়া উচ্ছে খাবেন না বলে!
ডায়েটাচারীদের কল্যাণে এখন বাজারে হেলথ ফুডের রমরমা। ব্রাউন ব্রেডের কথাই ধরুন, দশ বছর আগে ক’জন বাঙালি তার খোঁজ রাখত? কর্নফ্লেকসের বাংলা বিজয় তো রীতিমতো কেস স্টাডি। বাঙালির ব্রেকফাস্টে বেকড বিনস এমন বিপ্লব আনবে কে ভেবেছিল? স্বাস্থ্য সচেতনতা এখন বাঙালির ইন থিং। আর তার প্রধান হাতিয়ার এই ডায়েটিং। এক কালে বাঙালির বদনাম ছিল যে সে নাকি হরিমটর খেয়ে অনশন করে। আজ তার কতটা ঘুচেছে বলতে পারব না, কিন্তু বেশ টের পাই নতুন জেনারেশনের বাঙালি ক্রমেই তার খাদ্যাভ্যাস পাল্টে ফেলছে।
আর এই পাল্টে যাওয়া মানসিকতাকে মেনে চলতে এখন বাঙালিদের মধ্যে ওরিয়েন্টাল কুইজিনের জয়জয়কার। কলকাতার বুকে ক ’টা চাইনিজ রেস্তোরাঁ বনাম ক’টা মোগলাই খানাঠিকানা আছে তা গুনলেই সারসত্যটা টের পাবেন। তবু, আমার অবিশ্বাসী মন প্রত্যেক রবিবার বাজারে গিয়ে দেখে রেওয়াজি খাসির দোকানে লম্বা লাইন, আর তার দাম বেড়েই চলেছে। আর, তাই হয়তো সপ্তাহের মাঝখানে যে বাঙালি জিভ কেটে বলে, ‘ডায়েটে আছি’, সপ্তাহান্তে সে ডায়েট ফ্রি!
ডায়েট নিয়ে হাসি মশকরা থাক। একটু সিরিয়াস হয়ে চলুন। এই ক’দিন আগেই মনোহর আইচ মহাশয় শতবর্ষে পা রাখলেন, সেটা কিন্তু এক লম্বা ইনিংস ধরে একটা ডায়েট ফলো করেই। ডায়েট-এ মিলায় আয়ু তর্কে বহু দূর! পরিমিত আহার অপরিমিত জীবনীশক্তির বার্তা বহন করে এটা তার হাতেনাতে প্রমাণ। সাধে কি শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘বেশি খাবি তো কম খা!’ তো ডায়েট নিয়ে মত ও মতান্তর প্রচুর, আজকের আলাপ বরং শেষ করা যাক আমার পূর্বোক্ত বাল্যবন্ধুর একটি করুণ গল্প দিয়ে। বন্ধুটি এক বার বেড়াতে হরিদ্বার গেছে। গঙ্গাতীরের আরতি দেখে তার মনে বেশ ভক্তিভাব জেগে উঠেছে। সে ঠিক করে ফেলল সাধুর জীবন যাপন করবে। সাধু আহার, সাধু আচার। সম্পূর্ণ সদাচার। দিনে দু’বেলা খাবে। বাকিটা ধ্যানযোগ। মুশকিল হল এই ধ্যান নিয়েই। যত বার সে ধ্যানে বসে তত বার হয় কচি পাঁঠা নয় দেশি মুরগির স্বপ্ন দেখে। মহা ঝামেলা, ধ্যান ভাঙতেই তীব্র বিবেক দংশন। এ রকম মাসখানেক চলার পর সে আর এই যন্ত্রণা নিতে পারেনি। ব্যাক টু কলিকাল, ব্যাক টু কলিকাতা!

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.