|
|
|
|
|
|
সাপান্ত |
সাপ মানেই বিপদ, এই ধারণা সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন। স্রেফ কুসংস্কারের
বশে সাপ
হত্যা করা অত্যন্ত অমানবিক।
লিখছেন কৌশিক |
কিছু দিন আগে এক রাতে দক্ষিণেশ্বর থেকে বন্ধুর বিপন্ন ফোন। ওর এক প্রতিবেশীর বাড়িতে নাকি চন্দ্রবোড়া সাপ ঢুকে আলমারির মাথায় উঠে বসে আছে! বোঝালাম যে, ওই এলাকায় চন্দ্রবোড়ার দেখা পাওয়া অসম্ভব। সাপের চেহারার বিবরণ শুনে বুঝলাম, সেটি একটি দাঁড়াশ সাপ। বন্ধুকে অনেক করে বুঝিয়ে বললাম যে সাপটি নির্বিষ, মোটেও ক্ষতিকর নয়, অতএব আমি না যাওয়া অবধি সবাই যেন ধৈর্য রাখে। আমি মাঝরাস্তায়, এমন সময় ফের ফোন, নিরীহ সাপটিকে লাঠি দিয়ে মেরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে...!
কলকাতা বা তার সংলগ্ন এলাকায় আগে মাঝে মাঝেই ‘সাপ বেরনো’র সংবাদ পেতাম। ছুটে যেতাম নিরীহ প্রাণীটিকে মারমুখী জনতার হাত থেকে রক্ষা করতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিফল হয়ে ফিরতে হত। ‘কালনাগিনীর মারাত্মক বিষ’, ‘লাউডগা চোখ খুবলে নেয়’, ‘ঘরচিতির কামড়ে প্রাণ যেতে পারে’ আজ অবধি এ সবের কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
খুঁজে পাইনি। |
|
|
বেতআছড়া |
কালনাগিনী |
|
এক বার দুই-তিন বন্ধু মিলে সল্টলেকের বনবিতানে গিয়েছিলাম প্রজাপতি, পাখি ইত্যাদি দেখতে। সেখান থেকে আমাকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়, কারণ একটি দাঁড়াশ (টাস মিউকোসা) সাপকে কিছু ছেলেমেয়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম। দাঁড়াশের কামড় নাকি সাংঘাতিক, তার চেয়েও বড় কথা লেজের বাড়ি মারলে শরীরের আক্রান্ত স্থানে নাকি পচন ধরে যায়! হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের বোঝাতে পারলাম না যে এই সব একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। একই অবস্থা বটানিক্যাল গার্ডেনেও, যা নাকি পশুপাখিদের বিচরণের আদর্শ জায়গা। মানুষের অধিক বিচরণের ফলে সেখানেও আর সাপেদের দেখা মেলে না।
আমার বাড়ি মধ্য কলকাতার একটি সরকারি আবাসনে। আগে আমাদের আবাসন চত্বরে নালা নর্দমায় জলঢোঁড়া, ঘরচিতি, হেলে সাপেদের ঘুরতে দেখা যেত। আবাসিকেরা একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কোনও সাপ দেখলেই তা মেরে ফেলতে হবে এবং মারার পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অনেক বুঝিয়েও আমি এই কুসংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড রুখতে পারিনি। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে যে যার বাড়ির সামনের অংশ সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে নিলেন যাতে সাপ আর বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করতে না পারে। এখন আবাসন চত্বরে প্রচুর ইঁদুর দেখা যায়, যা সাপেদের অন্যতম প্রধান খাদ্য।
সে দিন এক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারলাম, উনি দক্ষিণ কলকাতার সেই জায়গায় ফ্ল্যাট কিনেছেন যেখানে আগে অনেক সাপ চোখে পড়ত। উনি খুব আনন্দের সঙ্গে বললেন যে জায়গাটা আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর হয়ে উঠেছে। |
|
|
চন্দ্রবোড়া |
শাঁখামুটি |
|
আগে প্রচুর ঝোপঝাড় ছিল, সেখানে এখন মাটি বলতে মার্বেল আর গ্রানাইট। জলাশয় বলতে একটি বিলাসবহুল সুইমিং পুল। বাইপাস সংলগ্ন এলাকাতেও গাছপালা, ঝোপঝাড় কেটে, জলাশয় বুজিয়ে উঁচু উঁচু ইমারত আর চওড়া রাস্তা তৈরি হচ্ছে। এখন এ সব জায়গায় আর আগের মতো সাপের দেখা পাওয়া যায় না। এত অবধি যা বললাম সবই নির্বিষ সাপের কথা। কলকাতা-সংলগ্ন এলাকায় কিছু দিন আগে পর্যন্তও বিষধর সাপের দেখা মিলত। গড়িয়ার পঞ্চসায়র, সল্টলেকের
|
লাউডগা |
নলবন অথবা বটানিক্যাল গার্ডেনে কেউটে (কেউটিয়া বা মনোক্লেড কোবরা) সাপ আমি ঘুরতে দেখেছি। নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাউকে কিছু করছে না। মানুষের সামান্য উপস্থিতি টের পেলেই নাগালের বাইরে। বিভিন্ন পোকামাকড়, ইঁদুর, ব্যাঙ ইত্যাদি ছিল এই সব সাপেদের খাদ্য। এখন আর তাদের দেখা যায় না। কিছু দিন আগেও সন্তোষপুর থেকে শাঁখামুটি সাপ (ব্যান্ডেড ক্রেট) উদ্ধার হয়েছিল। এক বার হাওড়ায় একটি পুরনো বাড়ির ভিতর থেকে চন্দ্রবোড়া (রাসেল্স ভাইপার) উদ্ধার করেছিলাম। এখন সেই সব জায়গায় শুধুই কংক্রিট-নির্মিত বহুতলের অস্তিত্ব।
চার দিকে নগরায়নের যত বৃদ্ধি ঘটছে ততই কমে যাচ্ছে সাপের সংখ্যা। এতটাই কমে যাচ্ছে যে কোনও কোনও প্রজাতির ক্ষেত্রে বিলুপ্তির আশঙ্কাও দেখা দিচ্ছে। মানুষের অন্ধ বিশ্বাস হল, সাপ মানেই বিপদ, অতএব সাপেদের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। যদি ধরেও নিই যে সাপ মানেই বিপদ, তাও তো সে যেচে কারও ক্ষতি করতে যায় না, বরং মানুষ দেখলেই পড়ি কি মরি করে ছুটে পালায়।
সহজ ভাবে বললে, শহরে যে মুষ্টিমেয় সাপ দেখা যায় তার অধিকাংশই নির্বিষ। এর মধ্যে রয়েছে জলঢোঁড়া (চেকার্ড কিলব্যাক), হেলে (ইন্ডিয়ান র্যাট স্নেক), লাউডগা (কমন ভাইন স্নেক), ঘরচিতি (কমন উলফ স্নেক), বেতআছড়া (ডেনড্রেলাফিস ট্রিসটিস) ইত্যাদি। আর বিষধর সাপ বলতে কেউটে, চন্দ্রবোড়া বা শাঁখামুটি। এর মধ্যে আবার শাঁখামুটি সাপটি মানুষকে কামড়ায় না, অন্তত এখনও পর্যন্ত কাউকে কামড়েছে বলে শোনা যায়নি।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষধর সাপ মানুষের শরীরে বিষ দেয় না, কারণ মানুষ সাপের খাদ্য নয় এবং সাপকে বিষ তৈরি করতে হয় অনেক কষ্ট করে। বিষধর সাপের কামড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের মৃত্যুর কারণ অহেতুক ভয়, ভ্রান্ত ধারণা এবং না জানা তথ্য। আমাদের জানা উচিত যে, সাপের বিষ থেকে বিভিন্ন জটিল রোগের ওষুধ তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, বাস্তুচক্রের ভারসাম্য রক্ষার জন্যও সাপেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ভীষণ জরুরি। অকারণে সাপ হত্যা না করে, সাপ সম্পর্কে মন থেকে অহেতুক ভয় এবং ভ্রান্ত ধারণা দূর করে আমাদের উচিত এই প্রাণীটির অস্তিত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। |
|
|
|
|
|