শতায়ু বাঙালি
স্মৃতির সরণি ধরে
ধুমতী নদীর ধার ঘেঁষে মাটির রাস্তায় ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছে বছর আটেকের ছেলেটি। সহিস স্কুলের কাছে বইখাতা হাতে দাঁড়িয়ে। গরমকালের সকাল। পথটুকু পার হয়ে বই নিয়ে একছুটে স্কুলে।
বাবার কাছে বায়না বন্দুকের। এবং সেটা আসল। বাবার সঙ্গে তা কিনতে কলকাতার ডালহৌসি স্ক্যোয়ারে। হাতেকলমে শেখানোর জন্য বন্দুক কোম্পানির লোকেরা ম্যান্টনের গলিতে নিয়ে গিয়েছিলেন ট্যাক্সি করে। তখন কোন ক্লাস হবে? চিকচিকে চোখ বলে সিক্স!
কথা হচ্ছিল নিখিলবাবু, নিখিলচন্দ্র নন্দীর সঙ্গে। মাস ছয়েক হল এই আইনজীবী শতবর্ষ পার করলেন। জন্ম ২২ অগস্ট, ১৯১২।
পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন বছর পাঁচেক হল। এখন বোসপুকুর রোডের পাঁচতলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসেন প্রতি বিকেলে। বলছিলেন, ‘এখানে পার্কের দিকে তাকিয়েই ফিরে যাই বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে।’ চনমনে মন নিয়ে এখনও শিঙাড়া, মাংস, মিষ্টি খুব আরাম করেই খান। আসলে মানুষটি স্বল্পাহারী। কিন্তু খেতে ভালবাসেন খুব, খানও বারে বারে।
ঘোড়া, তিন তিনটে বন্দুক, মানিকগঞ্জ কোর্ট, মক্কেল, মুহরি সব ফেলে মানিকগঞ্জ থেকে হিন্দুস্থান পার্কে চলে আসা ১৯৫০-এর ১১ মার্চ। “তার আগেও পড়াশোনার জন্য কলকাতায় এসেছি’’ বললেন নিখিলবাবু।
শতবর্ষ পেরিয়েও স্মৃতি প্রতারণা করেনি তাঁর সঙ্গে। গড়গড়িয়ে বলে গেলেন ৮৪ বছর আগে হিন্দু হস্টেলে থাকার স্মৃতি। “আমার ছিল ওয়ার্ড টু, রুম নম্বর ২৯। রুমমেট প্রথম বর্ষের বিজ্ঞানের অজিতগোপাল রায় ও চতুর্থ বর্ষের দু’জন নিয়ে মোট চার জন। আমাদের যে নাপিত ছিল নাম নীলু। সে দশ বছরের পুরনো ছাত্রদের নাম গড়গড় করে বলে যেত। ঠাকুর ভবতোষ চক্রবর্তীর হাতের রান্না এখনও মুখে লেগে আছে।’’
পশ্চিমের বারান্দায় বিদায়ী সূর্যের দিকে তাকিয়ে অতীতকে ফিরিয়ে আনলেন পাঁচ ফুট সাড়ে এগারো ইঞ্চির ঋজু নিখিলবাবু। হস্টেলে সঙ্গে থাকতেন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র দাদা মন্মথনাথ নন্দী। পরে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ থেকে শল্যচিকিৎসায় প্রথম ও মেডিসিনে গোল্ড মেডেল পেয়ে সে বার মেডিক্যাল কলেজকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল দাদা। সে কি আনন্দ! প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী নৃসিংহরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল বন্দ্যোপাধ্যায়, ভবতোষ দত্তদের কথা মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে তাঁর।
কিন্তু শতবর্ষের রেসিপিটা কী? নিখিলবাবু বলছেন, “পরিবারের অনেকেই দীর্ঘায়ু ছিলেন, তাই জিনগত ব্যাপারটা থেকেই যাচ্ছে। পাশাপাশি সুশৃঙ্খল জীবন তাঁকে এখনও সক্ষম রেখেছে।” শতবর্ষ পার করেছেন প্রবল উৎসাহে। শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানাতে এসেছিলেন আইনজীবীরা। উপহার পেয়ে এর মধ্যেই শেষ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’। সাহিত্যে ফেলে আসা বাংলার গন্ধ থাকলেই মজে যান সেখানে। স্মৃতিতে ভিড় করে আসে গোয়ালন্দ হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, খেলার মাঠ, মুগুর ভাঁজা, সাইকেল চালানো এবং অবশ্যই, ‘দ্যাশের’ ভাষা।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.