ব্যাগ গুছিয়ে...
সোঁদরবনের সুন্দরী
দোবাঁকি হয়ে আমাদের নৌকা ফিরছে। ঘড়ি বলছে বিকেল তিনটে। বিদ্যার জলে ভাটার টান। খাঁড়ি ধরে নৌকা চলছে দু’পাশের হেতাল বনকে সঙ্গী করে। চর জাগছে। এঁটেল মাটির বুকে রোদের আলো পিছলে যাচ্ছে। নৌকার জল ঠেলার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। পাখিগুলোও যেন ডাকতে ভুলে গেছে। মাঝি জানিয়েছে, এ পথে তার দেখা পাওয়া যেতে পারে। আমাদের তেরো জোড়া চোখ জঙ্গলের এক সেন্টিমিটার জায়গাও স্ক্যান করতে ভুলছে না। কারও মুখে কোনও কথা নেই। একটা লম্বা টানে নৌকাটা জল ঠেলে এগলো অনেকটা। এই জায়গায় জঙ্গল খানিকটা হাল্কা। প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ, হঠাৎই সে এল। গায়ে হলুদের নরম রোদ মেখে, কাজল কালো ডোরা নিয়ে দৃপ্ত পায়ে মাথাটা নিচু রেখে কাদার ভিতর পায়ের থাবায় জল ভাঙতে ভাঙতে ‘টাইগার পাম’-এর জঙ্গলে ঢুকে গেল। আমার শ্বাস পড়ছে না তখনও, লেন্স বন্দি করেছি তাকে। তবু চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। সোঁদরবনের সুন্দরী বাঘিনি! একি সত্যি!
শরীরে একটা শিরশিরানি। শীতের হাওয়ার সঙ্গে বাঘ দেখার উত্তেজনাটাও কাজ করছে। নোনা জলের গন্ধ বাতাসে। একটা চিল আকাশে বুক চিতিয়ে। তার থেকে চোখ সরাতে না সরাতেই দূরের চরায় সন্ত্রস্ত হরিণ। আমাদের দেখল একবার মুখ তুলে, আর তার পরেই নরম কাদা মাটিতে পা ঠুকে জঙ্গলের বুকে লুকিয়ে পড়া। আরও কিছুটা এগোতেই মাঝির ফিসফিসানি, ‘ডান দিকে দেখুন...’। দেখি প্রায় মাটি রঙা এক বুনো শুয়োরের বাচ্চা মাটি খুঁড়ে কিছু খাবারের সন্ধান পেয়েছে। পার হয়ে যাই। দেখি এক গাছের গায়ে লাল কাপড় বাঁধা। ওটা কি মাঝিভাই? “উখান থেকে কোনও মুনিষকে দখিনরায় তুলে নে গেছিলেন, তাই উই সাবধানী কাপড়।” বুঝলাম ওটি বাঘেদের ‘রেড এলার্ট জোন’। জলের মাঝে ছোট ছোট পাক। অজস্র শুকনো পাতা জলের বুকে রঙিন বিনুনি বেঁধেছে। জল সরে যাওয়ায় চরের মাটিতে ‘শুলো’ বা শ্বাসমূলেরা মাথা তুলেছে। ঠেসমূলেরাও কেমন হাতের আঙুলের মতো মাটি আঁকড়ে ধরে রেখেছে ম্যানগ্রোভদের। কাদা-মাটির ক্যানভাসে সবুজের অফুরান ছোঁয়া চোখকে বড় আরাম দেয়। বাইনের ডালে বসা মাছরাঙাটা চোখ টেরিয়ে তাকায়। লালপানা ঠোঁটটা পড়ন্ত রোদে আরও লাল।
পাখিরালা ছুঁয়ে সজনেখালির কাছাকাছি যখন তখন দিন শেষের সূর্য অকৃপণ হাতে সোনা ছড়াচ্ছে নদীর জলে, জল নামতে থাকা চরের কাদামাটিতে, আর আমাদের শরীরেও।
রাতে লজে জমাটি খাবার শেষে লজের হাতায় কাঁকড়া গাছের ডালে ডালে বাঁদরদের খুনসুটি দেখতে দেখতে রাত ঘুমের প্রস্তুতি নেওয়া। পর দিন সকালে গরম গরম লুচি, সব্জি, ডিমসেদ্ধ আর মিষ্টি দিয়ে জলখাবার সেরে সাতটার মধ্যে নৌকায় উঠে পড়া। আজ দুপুরে নৌকাতেই খাওয়া। মাঝিকে বলে দেওয়া হয়েছে আলু, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি আর পারশের ঝাল কোরো ভাই।
ভেসে চলেছি। এখন জোয়ার। মাতলায় ভরা যৌবন। বদর, বদর। আমাদের নৌকা ছোট ছোট নদী আর সরু ভারানি দিয়ে সজনেখালি থেকে পঞ্চমুখানি হয়ে পীরখালি ছুঁয়ে সুধন্যখালি। জল-জঙ্গলে ভরা খাঁচার মাঝ দিয়ে পথ পৌঁছেছে ‘ওয়াচ টাওয়ারে’। টাওয়ার থেকে দেখা যায় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের গভীর বন। সুন্দরী, বাইন, হেতাল, কাঁকড়া বাঘেদের স্বাভাবিক বসতি। টাওয়ারের নীচে মিষ্টি জলের পুকুর। জঙ্গলের বুক চিরে পথ এসে মিশেছে সেখানে। বনচরেরা আসে সেখানে, তৃষ্ণা মেটাতে। আমরা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটা হরিণ ছানা আর শিংওয়ালা এক চিতল এল জল খেতে। নজরে এল এক গোসাপও। কাউকে ভয় দেখাতে মাটিতে লেজ আছড়াচ্ছে। নজর মিনার থেকে ফেরার পথে দু’ধারের কাদা জমিতে অজস্র লাল কাঁকড়ার ছোট ছোট পদক্ষেপ, যেন ব্যালে নাচের তালিম নিচ্ছে। মজার দৃশ্য।
ভাসলাম আবার। এক ঝাঁক টিয়া, ধূসর-নীল আকাশে ফ্রেম হয়ে গেল। একটা ন্যাড়া গাছের শুকনো ডালে বসলো একটা সারপোট ঈগল। আমাদের নৌকা জল কাটছে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর এক গাছের মাথায় ‘অ্যাডজুরাস্ট স্টর্ক’। শক্তপোক্ত একটা ঠোঁট নিয়ে বসে আছে। আমরা একটু কাছাকাছি আসতেই ডানা মেলল। সপ্ সপ্ শব্দ বাতাসে। আজ আমাদের কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। যে দিক পানে খুশি চলা, খাড়ির ভিতরে ভিতরে। এমনি ভাসতে ভাসতেই হঠাৎ নজরে এল এক বিরাট ‘অ্যাসচুরিয়ান ক্রোকোডাইল’। নাক, চোখ আর পিঠের কিছুটা ভাসিয়ে চলেছে। কিছু পরেই জলে ডুব দিল সে। আবার খানিকটা এগোতেই তার আর এক দোসরের দেখা মিলল। লেজ দিয়ে জলের বুকে আলপনা তুলে সেও হারালো অতলান্তে। সামনে নাকি ‘জটিরামপুর বার্ড স্যাংচুয়ারি’। চালাও পানসি। পথ দেখালো এক ঝুঁটিওলা বক। শুকনো গাছে ডাল ঝুঁকে আছে জলের উপর। পাঁচটা পানকৌড়ি তাতে, ‘পিকচার পোস্টকার্ড’। বার্ড স্যাংচুয়ারিতে নামা দায়। যা কাদা, সে নাকি আমার বুক সমান। অতএব নৌকায় বসে অপেক্ষা আর ছবি তোলা। নোঙর করা হল। এক দফা লেবু চা।
ঘণ্টাখানেক পর নোঙর তোলা হল। গা ভাসালো নৌকা আর আমার মন। ফিরছি যখন, কমলা পানা সূর্যিটা বড় নরম আলো দিচ্ছে। সুন্দরবনের হলুদ নদী আর সবুজ বন তাদের সুবটুকু দিয়ে নিচ্ছে তাকে। নদীর ধার ঘেঁষে মীন ধরার জাল টানছে যে বউটি, বাঘ আর কুমীরের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যে মানুষগুলো বাদা বনের জঙ্গলে ঢোকে কাঠ কুড়োতে আর মধু সংগ্রহ করতে তাদের হৃদয়ের সব ভালবাসাটুকু নিয়ে আবারও পরের দিন দেখা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নদীর জলে গা ডোবালো সূর্যিটা। মাছরাঙাটা ডাকতে ডাকতে সরে যেতে থাকল। নদী তার রেশটুকু ধরে রাখলো অনেকটা সময় জুড়ে।

কী ভাবে যাবেন
সুন্দরবনের নানা দিকে নানা ভাবে যাওয়া যায়। এ লেখায় যে পথের কথা বলা আছে সে পথে
যেতে হলে শিয়ালদহ (দক্ষিণ) থেকে ক্যানিং-এর ট্রেনে উঠে ক্যানিং নামুন। সেখান থেকে
মিনিবাস অথবা শেয়ারের গাড়িতে মিনিট পঞ্চাশে গদখালি। সেখান থেকে মাথাপিছু এক টাকা
হারে দশ মিনিটে নৌকায় উল্টো দিকে গোসাবা। চাপুন ভ্যানরিকশায়। পঞ্চান্ন
মিনিটে পৌঁছন পাখিরালা। সেখান থেকে দশ মিনিটে ওপারে সজনেখালি।
কখন যাবেন
গরমের শেষ থেকে বর্ষা বাদ দিয়ে অন্য সময়ে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.