তিয়েনআনমেন গণহত্যার ভূত আজও তা হলে তাড়া করে চিনকে।
এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে চব্বিশ বছর পরও সে স্মৃতিকে একই রকম ভাবে অন্ধকার নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিন। তাই প্রশ্ন, চলতি ব্রিকস সম্মেলনে পরিবর্তনের বার্তা দিলেও বাস্তবে ঠিক কতটা বদল এসেছে চিনা মানসিকতায়?
বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলেছে একটি ঘটনা। সম্প্রতি মাইক্রোব্লগিং সাইটে ছড়িয়ে পড়ে চিনা ‘ফার্স্ট লেডি’ পেঙ লিউয়ান-এর ১৯৮৯ সালের একটি ছবি। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, সবুজ সেনা ইউনিফর্মে গান গাইছেন যুবতী পেঙ। তাও আবার সেনাবাহিনীর উদ্দেশে। ইতিহাস বলছে, ওই বছরই ৩-৪ জুন এই সেনাবাহিনীর হাতেই ঘটেছিল বেজিংয়ের অন্যতম নৃশংস হত্যালীলা। গণতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল করে যে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী জমায়েত হয়েছিলেন তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে, সেই নিরস্ত্র পড়ুয়াদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল এই সেনাই। সেই সেনাদের জন্য গান গেয়েছিলেন চিনের বর্তমান ফার্স্ট লেডি। গণহত্যার স্মৃতিকে উস্কে দেওয়ার পক্ষে ওই একটি ছবির তাৎপর্য বুঝতে পারে চিনা প্রশাসন। তাই ইতিমধ্যেই চিনা সাইট থেকে সেটিকে মুছে দেওয়া হয়েছে।
বিতর্কের শুরু এখান থেকেই। পাশ্চাত্যের দেশগুলো তো বটেই, একই সঙ্গে চিনের বাসিন্দাদের একাংশেরও প্রশ্ন, গণতন্ত্রের বুলি কপচালেও আদৌ কি চিন গণতান্ত্রিক মানসিকতায় বিশ্বাসী? জিনপিং-এর হাত ধরে আসা পরিবর্তন কি শুধুই পোশাকি? না হলে, চব্বিশ বছর পরও তিয়েনআনমেন গণহত্যা নিয়ে একই রকম মনোভাব কেন চিনের? সে দিনও গণহত্যার স্মৃতি মুছতে তৎপর ছিল চিনা প্রশাসন। আজও সেই স্মৃতিতে ইন্ধন জোগায়, এমন কোনও তথ্য-প্রমাণ রাখতে নারাজ চিন। |
ফৌজি উর্দিতে তরুণী পেঙ। তিয়েনআনমেনে গণতন্ত্র হত্যার বছরেই
সেনাদের জন্য গান গেয়েছিলেন তিনি। সে ছবি অবশ্য উধাও। —ফাইল চিত্র |
তবে রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, পরিবর্তনের যে ভাবমূর্তি খাড়া করার চেষ্টা করছেন জিনপিং এবং তাঁর স্ত্রী পেঙ্গ, এ ছবি ছড়িয়ে পড়লে সেই ভাবমূর্তি ধাক্কা খেত ষোলো আনা। তাই নিজেদের চেনা রাস্তায় হাঁটল চিন সরকার।
ফলও মিলেছে হাতেনাতে। তড়িঘড়ি ছবি মুছে ফেলায় চিনের খুব কম সংখ্যক বাসিন্দাই ছবিটি দেখতে পেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, চিনের নয়া প্রজন্মের কাছে তিয়েনআনমেন স্কোয়্যার অনেকটাই অজানা। ফলে তাদের মধ্যে যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁদের মনেও সে ভাবে প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারেনি ছবিটি। আবার অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন বিশেষজ্ঞ ওয়ারেন সান ছবিটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।
পেঙ্গ-এর সমর্থকরা অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি নরম। তাঁদের দাবি, তিয়েনআনমেনের ঘটনার সময়ই পেঙ্গ-এর স্বামী শি জিনপিং পূর্ব চিনের একটি শহরের নেতা। পেঙ্গকে তাই দল তথা রাষ্ট্রের অনুগত সেনাবাহিনীর জন্য গান গাইতেই হয়।
হয়তো সে রকম কিছু বাধ্যবাধকতা কাজ করেছিল ২০০৭ সালেও। ১৯৫৯ সালে তিব্বত আক্রমণ করেছিল যে চিনা বাহিনী, তাঁদের জন্য ২০০৭ সালে গান গেয়েছিলেন পেঙ্গ। কিন্তু কী এমন সেই বাধ্যবাধ্যকতা?
উত্তর নেই। কিংবা উত্তর রয়েছে চিনা রিপোর্টার সান লি-র উৎকণ্ঠায়। ১৯৮৯ সালের পেঙ্গ লিউয়ানের ছবিটি ছাপা হয়েছিল একটি সেনা ম্যাগাজিনে। বেশ কিছু বছর আগে যেটি মোবাইলবন্দি করেছিলেন লি। মুছেও দিয়েছিলেন তড়িঘড়ি। সে ছবি আবার মাইক্রোব্লগে ফিরল কী ভাবে, ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
উদ্বেগ কম নয় পরিবর্তনের ডাক দেওয়া জিনপিং প্রশাসনেরও।
ছবি মুছলেও তিয়েনআনমেনে গণতন্ত্র হত্যার ইতিহাস মোছা যাচ্ছে না কিছুতেই! |