ডারবানে সদ্যসমাপ্ত ব্রিকস সম্মেলনে চিনের নয়া প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাঁর বক্তৃতায় নিজের দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা কমপক্ষে তিন বার উল্লেখ করেছেন। বারবার বলেছেন, রাজনৈতিক সংস্কারের কথা। যা শুনে সভায় উপস্থিত বিভিন্ন সদস্য দেশের কূটনীতিকরা প্রশ্ন তুলেছেন, সমাজতান্ত্রিক চিনের প্রেসিডেন্ট হঠাৎ এত বেশি করে গণতন্ত্রের কথা বলতে শুরু করেছেন কেন? তিনি কি সত্যিই পারবেন এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে?
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের মতো নেতারা অবশ্য মনে করেন, সমাজতন্ত্র গণতন্ত্র বিরোধী ধারণা নয়। বরং গণতন্ত্রের উন্নততর বিকাশই হল সমাজতন্ত্র। ভারতীয় মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকরা অনেক দিন ধরেই বলে এসেছেন, চিনে যা প্রতিষ্ঠিত, তা হল সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। পশ্চিমি তাত্ত্বিকরা পুঁজিবাদকেই গণতন্ত্র বলে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধ লাগিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ তাঁদের।
প্রশ্ন হল, তা-ই যদি হয়, তা হলে চিনের প্রেসিডেন্ট ডারবানে এসে এত ‘গণতন্ত্র’-‘গণতন্ত্র’ চিৎকার জুড়লেন কেন? কূটনীতিকরা মনে করছেন, আসলে গত কয়েক বছর ধরেই চিন অনেক বেশি করে খোলাবাজার অর্থনীতির দিকে এগিয়ে চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে একটি লোহার খাঁচায় আবদ্ধ করতে চেয়েছিল। সেই কারণে তা বুমেরাং হয়ে যায়। কিন্তু চিন অনেকটা জানলা খুলে উষ্ণ বাতাস বার করে দিয়ে নিজেদের ব্যবস্থা বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। শুধু বাঁচিয়ে রাখাই নয়, সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির নামে হুড়হুড় করে এগিয়েও গিয়েছে তারা। ফলে দেশের সার্বিক আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। রফতানি বেড়েছে। বেড়েছে বিভিন্ন দেশে আর্থিক বিনিয়োগও। সস্তার চিনা শ্রমিক পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। সব মিলিয়ে এখন বিশ্ব বাজারের অনেকটাই দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে চিন। ফলে চিনা ড্রাগনের নিঃশ্বাসে উদ্বিগ্ন পৃথিবীর তাবড় বৃহৎ অর্থনীতি।
এত সাফল্যের পরেও তা হলে কেন চিনা রাষ্ট্রপ্রধানের গলায় গণতন্ত্রের বুলি? কেন এক দলীয় শাসনব্যবস্থার বদলে আরও অনেকগুলি রাজনৈতিক দলকে পরিসর দেওয়ার দাবি উঠছে সরকার ও দলের বিভিন্ন স্তর থেকে?
ডারবানে উপস্থিত দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ইনস্টিটিউট অফ সাউথ আফ্রিকান স্টাডিজ’-র অধ্যাপক আদামা গায়ে তাঁর ‘চায়না-আফ্রিকা: দ্য ড্রাগন অ্যান্ড দ্য অস্ট্রিচ’ বইয়ে বলেছেন, চিনের অর্থনীতির উন্নতিতে সে দেশে বিত্তশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। সমাজে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি বাড়ছে। এ দিকে বাজার খুলে দেওয়ায় দেশে ইন্টারনেট বিপ্লব হয়েছে। ফলে বহু ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র ইন্টারনেটকে রুখতে চাইলেও পারছে না। ‘আরব বসন্তের’ আগে-পরে মিশর-সহ একাধিক ইসলামি রাষ্ট্রে যেমনটা হয়েছিল। ওই দেশগুলির শাসনযন্ত্র ইন্টারনেট বা ফেসবুক ব্যবহারের উপর ফতোয়া জারি করেও যুব সমাজকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। গণতন্ত্রের দাবি না মানা হলে তা যে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই ভেঙে ফেলতে পারে, তিয়েন আন মেন বিক্ষোভের সময়ই চিনের শাসকরা তা বুঝতে পেরেছিলেন। যে ঘটনাকে প্রকাশ কারাট বলেছিলেন, ‘চিন জানলা খুলতে গিয়েছিল। তাতে কিছু ম্যালেরিয়াবাহী মশা ঢুকে পড়ে। ফলে চিনে ম্যালেরিয়া হয়। এখন সেই ম্যালেরিয়া সারাতে হবে চিনকে’। তার পরে অনেক বছর কেটে গিয়েছে। এখন চিনের নতুন নীতির পর্যালোচনা শুরু করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-নিরুপম সেনরা।
প্রশ্ন উঠছে, চিনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে যা বলা হচ্ছে, তা কি বাস্তবে রূপায়ণ করা সম্ভব? তা হলে তো মার্ক্সবাদের মূল পরিকাঠামোই বদলে যাবে। আসলে চিনের ক্ষেত্রে গোটা বিষয়টি এখন উভয়সঙ্কটের সামিল। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু নাথান বলছেন, ১৯৮৯ সালের সঙ্কটের পরে চিনা প্রশাসন আরও দমনমূলক রাস্তা নেয়। আরও বেশি করে দমনমূলক রাস্তা নিয়ে প্রতিবাদকে থামিয়ে দেয়। সেটাই ছিল সে সময়ে চিনের স্থিতাবস্থাকে বজার রাখার রাস্তা। এখন শি জিনপিং বলছেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন তাঁরা। দেশের এক শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠছে, তা-ও দমন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। জিনপিং এক দিকে বেশি করে বাজার অর্থনীতির সামনে দরজা খুলে দেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। আবার পরক্ষণেই জানাচ্ছেন, তিনি যা করছেন, তা সবই কমিউনিজমের উপলব্ধি। এবং তিনি সেই বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। এক দিকে জিনপিং সাবেকি কমিউনিস্ট পরিভাষাকে ধরে রাখতে চাইছেন। আবার জাতীয় স্তরে সরকারের প্রতি দেশবাসীর যে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে, তার অনেকটাই ইন্টারনেট-ফেসবুকের মাধ্যমে বের করে দিতে চাইছেন তিনি। উদ্দেশ্য হল, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যাতে পুঞ্জীভূত না হয়ে একটি ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে যায়।
রাজনৈতিক সংস্কার বলতে জিনপিং কী বুঝিয়েছেন, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস (এনপিসি)-এর মুখপাত্র ফু ইউঙ্গ বলেছেন, রাজনৈতিক সংস্কার মানেই এক দলীয় থেকে বহু দলীয় শাসনব্যবস্থায় চলে যাওয়া নয়। চিনা বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নতি ও বিকাশ। আবার ইউঙ্গ এটাও বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যর্থতা নিয়ে গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সেনাবাহিনীর উপর থেকে দলের নিয়ন্ত্রণ হারানো চলবে না। চিনের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে এক ভারতীয় কূটনীতিকের মন্তব্য, “আর যা-ই হোক, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কিন্তু গরবাচভ হতে চান না। বরং তিনি গরবাচভের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোচ্ছেন।” ১৮৫৬ সালে ফরাসি ইতিহাসবিদ অ্যালেক্সি তকেভিল তাঁর ‘দ্য ওল্ড রেজি্ম অ্যান্ড দ্য রেভলিউশন’ বইয়ে ফরাসি বিপ্লবের সময়কার পরিস্থিতি বিশ্লেষন করেছিলেন। ওই বইয়ে তকেভিল বলেছেন, ‘সব সময় নেতিবাচক কারণে, যেমন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ থেকেই বিদ্রোহ হয় না। অনেক সময়েই ক্ষমতাসীন শাসক দল প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে’। এই বইটি নিয়ে এখন চিনের বিশিষ্ট মহলে তোলপাড় চলছে। কারণটাও স্পষ্ট। চিনে বহু লড়াইয়ের পরে সমাজতন্ত্র এসেছে। এখন শাসক দল যদি প্রতিশ্রুতি পালন না করে, তা হলে ফের ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য বিদ্রোহের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকেই।
সব মিলিয়ে চিনের কাছে এখন উভয়সঙ্কট। অতিরিক্ত সংস্কারের পথে হাঁটলে সোভিয়েত ইউনিয়নের দশা হতে পারে। আবার একেবারে না করলে গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়তে পারে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই জিংপিং-এর চিন কোন পথে এগোবে, তা যেমন ওবামা উদগ্রীব হয়ে লক্ষ্য রাখছেন, তেমনই পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে মনমোহন সিংহের ভারতও। নজর রাখছে গোটা দুনিয়াই। |