|
|
|
|
গরিবদের বাড়ি তৈরির টাকা বরাদ্দ তৃণমূল-ঘনিষ্ঠদের নামে |
কিংশুক গুপ্ত • লালগড় |
কেউ থাকেন রাজবাড়িতে। কারও আছে পাকা বাড়ি। তবু তাঁদের নামেই বরাদ্দ হয়ে গিয়েছে সরকারি প্রকল্পে গরিবদের জন্য বাড়ি বানানোর টাকা। প্রাপকদের মধ্যে মিল একটাই। হয় তাঁরা নিজেরাই তৃণমূল নেতা, নয় কোনও নেতার স্ত্রী, ভাই, জামাই। জঙ্গলমহলের রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র লালগড়ে শাসকদলের একটা বড় অংশের
বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ কিন্তু এসেছে দলেরই অন্দর থেকে।
রবিবার লালগড়ে তৃণমূল ব্লক কার্যালয়ে দলের ব্লক সভাপতি বনবিহারী রায়ের কাছে এই ‘স্বজনপোষণের’ প্রতিবাদে তুমুল বিক্ষোভ দেখান দলীয় কর্মীদের একাংশ। পদ থেকে ইস্তফা দেন ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি তন্ময় রায়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি তথা শালবনির বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাতোকে লেখা ইস্তফাপত্রে লালগড়ের নেতাই গ্রামের বাসিন্দা তন্ময় লিখেছেন, এই ঘটনায় ‘আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে জনগণের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছবে’।
প্রকাশ্যে না বললেও তন্ময়ের আক্ষেপ, “মানুষের জন্য কাজ করতে এসেছিলাম। এখন দেখছি, তা সম্ভব নয়। যা জানানোর, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বকে জানিয়েছি।” দলের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির এমন অভিযোগ প্রকাশ্যে আসায় রীতিমতো অস্বস্তিতে শাসক দল। শ্রীকান্ত মাহাতোর বক্তব্য, “একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। আমরা দেখছি, যাতে প্রকৃত গরিবেরা ওই প্রকল্পের টাকা পান।” তাঁর সংযোজন, “তন্ময়ের ইস্তফা গৃহীত হবে কি না, তা নিয়ে দলে আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হবে।” যে প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক, তার নাম ‘অধিকার’। বিপিএল তালিকায় নাম নেই এমন গরিব মানুষকে বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার প্রকল্প এটি। দু’কিস্তিতে মোট ৪৮,৫০০ টাকা মেলে। কেন্দ্র ও রাজ্য ৫০ শতাংশ করে টাকা দেয় প্রকল্পে। কারা টাকা পাবেন তা বাছেন স্থানীয় বিধায়ক। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিধায়কের বিবেচনাই চূড়ান্ত, অন্য নির্দেশিকা নেই। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর সেই তালিকার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের কাছে বরাদ্দ অর্থ পাঠিয়ে দেয়। জেলা ট্রেজারি থেকে চেক ব্লকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
লালগড় (বিনপুর ১) ব্লকটি ঝাড়গ্রাম বিধানসভার অন্তর্গত। ঝাড়গ্রামের তৃণমূল বিধায়ক তথা পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা তাঁর এলাকার ২৪৩ জনের নাম এই প্রকল্পে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৭৬ জন লালগড় ব্লকের। অভিযোগ, ১৭৬ জনের অধিকাংশই হয় স্থানীয় তৃণমূল নেতা না হয় তাঁদের ঘনিষ্ঠ। শনিবার লালগড় ব্লক অফিস থেকে প্রথম কিস্তির চেক বিলি শুরু হয়।
বিলি করেন খোদ পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী। বিডিও অভিজিৎ সামন্ত জানিয়েছেন, ওই দিন ১১০ জনকে চেক দেওয়া হয়েছে।
চেক বিলির পরেই ক্ষোভ ছড়ায় স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একটা বড় অংশে। তাঁদের ক্ষোভ, বাসস্থানের সমস্যা না থাকলেও প্রাপক তালিকায় নাম ঢুকেছে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি বনবিহারী রায়ের দুই ভাই ও এক জামাইয়ের। নাম রয়েছে প্রদেশ তৃণমূল কমিটির সদস্য অনুপসাহস রায়, ব্লক কমিটির সদস্য ধনঞ্জয় রায়, ব্লক সদস্য করুণাকেতন রায়ের স্ত্রী প্রতিমা রায়, দলের ধরমপুর অঞ্চল সভাপতি দিলীপ মাহাতোর স্ত্রী টুলুরানি, ধরমপুর যুব অঞ্চল সভাপতি মৃণালকান্তি মাহাতো, তৃণমূলের বৈতা অঞ্চল সভাপতি লসো হেমব্রম, বৈতা যুব অঞ্চল সভাপতি শৈলেন আচার্য প্রমুখর।
বনবিহারীবাবু এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। চেক প্রাপকদের তালিকায় নাম থাকা অনুপসাহস রায় লালগড় রাজ পরিবারের সদস্য। লালগড় রাজবাড়ির এক তলার একটি অংশে থাকেন। অনুপবাবুর দাবি, “আমার নামে বাড়ির টাকা বরাদ্দ হয়েছে বলে জানি না।” প্রথম কিস্তির চেক পেয়েছেন টুলুরানি মাহাতো। তাঁর স্বামী জনগণের কমিটির প্রাক্তন নেতা দিলীপ মাহাতো এখন তৃণমূলের ধরমপুর অঞ্চল সভাপতি। দিলীপবাবুর বক্তব্য, “সিপিএমের হার্মাদেরা ভুলাগাড়া গ্রামে আমার বাড়ি ভেঙে দিয়েছিল। আমার বাড়ি নেই।” তা হলে যে লালগড় ব্লক-সদরে আপনি পাঁচিল ঘেরা পাকা বাড়ি তুলছেন? জবাব দেননি দিলীপবাবু।
আর পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমারবাবুর বক্তব্য, “প্রকৃত দুঃস্থদের তালিকা তৈরি করার জন্য ব্লক স্তরে দলের নেতা-কর্মীদের সাহায্য চেয়েছিলাম। কারণ, আমার পক্ষে সব জায়গায় গিয়ে জনে-জনে পরীক্ষা করে তালিকা গড়া সম্ভব নয়। সেই তালিকায় গণ্ডগোল হয়েছে বা কোথায়, কী ভুলভ্রান্তি হয়েছে সেটা খবর নিয়ে দেখছি। তার আগে বিশদ বলতে পারছি না।” সরকারি প্রকল্পের প্রাপক ঠিক করতে দলের লোকের সাহায্য নিলে বিরোধী পক্ষের লোকেদের বাদ পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় না? মন্ত্রীর জবাব, “আমি স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী। অস্বচ্ছ কিছু হোক, এটা আমি চাইনি।” কিন্তু দলেরই একাংশের তরফে যে স্বজনপোষণের অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা তো মন্ত্রীর উপরেও বর্তায়? সুকুমারবাবু বলেন, “অভিযোগটা আমার কানেও এসেছে। বলছি তো খোঁজ নিচ্ছি।”
শাসক দলের ভিতর থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় জোর বেড়েছে বিরোধীদের গলাতে। বিনপুরের সিপিএম বিধায়ক দিবাকর হাঁসদার বক্তব্য, “আমার এলাকায় গরিব মানুষের সংখ্যা ঝাড়গ্রামের তুলনায় বেশি। অথচ, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর আমার কাছ থেকে কোনও তালিকা চেয়ে পাঠায়নি। আসলে উন্নয়নের নামে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি চলছে।” একই অভিযোগ করেছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার। তাঁর টিপ্পনী, “রাজ্যের বর্তমান সরকারের চক্ষুলজ্জা নেই। এটা দলবাজদের সরকার।” জেলা কংগ্রেসের সভাপতি স্বপন দুবের কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী বার বার জঙ্গলমহলে এসে উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়ার বুলি আওড়াচ্ছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়ন তাঁর দলের লোকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।” ঘনিষ্ঠ মহলে লালগড়ের নিচুতলার তৃণমূলকর্মীদের একটা বড় অংশও মানছেন, দলের ভিতর থেকে দলের নেতাদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায়, তাঁরা ‘ফাঁপরে পড়েছেন’। অনেকে বলেও ফেলছেন, “এর পরে আর কোন মুখে গরিব মানুষের কাছে ভোট চাইতে যাব?” |
|
|
|
|
|