৪-০ জিতে উঠে ট্রফি নিয়ে ভিকট্রি ল্যাপ হল। গ্রুপ ফটো তোলা হল সবাই মিলে। এগুলোর মধ্যে কোনও বৈচিত্র নেই। নতুনত্ব যেটায় ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের ভিকট্রি ল্যাপের মধ্যেই কোহলি-অশ্বিন-রবীন্দ্র জাডেজারা ভাংড়া শুরু করে দিলেন! ভিকট্রি ল্যাপে ভাংড়ারোববার কোটলার আগে পর্যন্ত ভারতের কোনও ক্রিকেট মাঠ দেখেনি। যা দেখে হঠাৎ মনে হবে, কোথায় যেন একটা নতুন জমানা চোখের সামনে হাজির হয়ে গিয়েছে। যারা সাবেকি ভিকট্রি ল্যাপ-ট্যাপের ধার ধারে না। এই জেনারেশন ওয়াই-এর জগতে তিনি, সচিন তেন্ডুলকর এখন কী করবেন? তাঁকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ভাংড়ায় থাকবেন? না, বরাবরের সনাতন ক্রিকেট ঐতিহ্যের প্রতিভূ থেকেই চিরপ্রস্থান করবেন?
গোটা ভারতে এখন কোটি টাকার প্রশ্ন, সচিন কি নিজেকে আরও টানবেন? নাকি নিজেকে সেই অভিজাত গ্রহে রেখে সম্মানজনক স্বেচ্ছা বিদায় নেবেন?
কোটলা সেন্টিমেন্টের ধার ধারে না বলে চিরদিন পরিচিত। এখানেই গাওস্করকে নেট প্র্যাক্টিসের সময় শুনতে হয়েছিল, ‘সানি, তেরে পিছে মার্শাল আ রহা হ্যায়’! সেই মাঠও এ দিন সচিনকে দেশের মাঠে তাঁর শেষ (আর সম্ভাব্য বলার প্রয়োজন নেই) টেস্ট ইনিংসে আবেগে ভিজিয়ে দিল। স্কোরবোর্ডে ভারতের একশো রান ওঠা মাত্র স-চি-ন, স-চি-ন চিৎকার শুরু হল। যেন এখুনি একটা উইকেট পড়া চাই। আজ ওকে দেখতে চাই উইনিং স্ট্রোক মারার জন্য। এত চিৎকার হল যে, ধোনি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্বীকার করলেন, “ইশান্ত খুব রেগে গিয়েছিল। কোহলিকে যে ভাবে ‘গেট আউট-গেট আউট’ বলা হচ্ছিল গ্যালারি থেকে!” |
দুপুর ৩-১৬ মিনিটে ক্রিকেটদেবতার ব্যাট হাতে কোটলার ক্রিজে রাজসিক প্রবেশ। ৩-২৪ মিনিটে হতদরিদ্র হয়ে প্রস্থান। শোকার্ত কোটলা-ও যেন দ্রুত আবার তার বরাবরের পরিচিত কর্কশ বাস্তবতায় ফিরে গাওস্কর-যুগে চলে গেল। প্রেসবক্স সংলগ্ন কোটলার যে অংশটা ভিভিআইপি-দের এলাকা সেই এয়ার কন্ডিশন্ড বক্সে অনেককে দেখা গেল বিরক্ত ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলাবলি করছেন কব যাও গে!
এমনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সচিনের যা পারফরম্যান্স, একটা রূপকথার আস্ত বই হয়ে যায়। ৩৯ টেস্টে ৩৬৩০ রান। গড় ৫৫। এমনকী অস্ট্রেলিয়ার মাঠেও টেস্ট গড় ৫৩। এই সিরিজেও সচিন ভেবেছিলেন শেষ করবেন রাজবেশে।
এখনও তাঁর বাসনা দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ডেল স্টেইন পিটিয়ে সেঞ্চুরি করবেন। প্রখর রোম্যান্টিসিজম দিয়ে তাঁর ক্রিকেটজীবন শুরু হয়েছিল পাকিস্তানে। শেষ করতে চান দু’শো টেস্ট খেলার অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব এবং রোম্যান্টিসিজম গায়ে মেখে। রবিবার রাতেও বলেছেন, “বড় ইনিংস আসছে। শিগগিরই আসছে।”
এটা কি নিছক চ্যাম্পিয়নের ইগো? নাকি বাস্তবতার সঙ্গে মানানোর অক্ষমতা? সচিন কি জেগে থেকেই ক্রিকেটের রিপ ভ্যান উইঙ্কল হয়ে গেলেন? নাকি বরাবরের মতোই রূপকথার যুদ্ধটা জিতবেন? |
সুনীল গাওস্কর: টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৪-০ জয় খুব বেশি নেই। এই সিরিজে ভারত সব বিভাগে দাপট দেখিয়েছে। দলগত জয়ই বলব।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়: এমন একটা সিরিজ জয় সত্যিই অসাধারণ। তবে এই দলটা কতটা ভাল সেটা বিচার করার আগে ওদের সময় দিতে হবে। আগামী ১৭-১৮ মাসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যেই ধোনিকে টিমটা তৈরি করে নিতে হবে।
গৌতম গম্ভীর: অভিনন্দন দলের সবাইকে। দারুণ জয়। দুরন্তভাবে উপভোগ কর। হোয়াইটওয়াশই প্রাপ্য ছিল।
শেন ওয়ার্ন: সিরিজ জয় এবং যে ভাবে ভারতের তরুণ ক্রিকেটাররা পারফর্ম করল তার জন্য ভারতীয় দলকে অভিনন্দন।
গ্লেন ম্যাকগ্রা: গোটা সিরিজেই দাপট ছিল ভারতীয় ক্রিকেটারদের। অ্যাসেজের আগে প্রচুর ঘাম ঝরাতে হবে অস্ট্রেলিয়াকে।
জাহির খান: দুরন্ত সিরিজ জয়ের জন্য ভারতীয় দলকে অভিনন্দন। |
|
এমনিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সচিনের সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে চান না। বোর্ড নিযুক্ত ভাষ্যকারেরা তো বটেই, এমনকী ঠোঁটকাটা দিলীপ বেঙ্গসরকরও এ দিন মুম্বই থেকে ফোনে বলছিলেন, “সচিনের ফিটনেসের কী অবস্থা, মানসিকতার কী অবস্থা, সেই প্রশ্নের জবাব ও-ই দিতে পারবে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় টিমে মনে হয় ধোনির ওকে লাগবে। ওখানে ডেল স্টেইনদের সামনে অভিজ্ঞতা দরকার।”
কিন্তু অনেকেই বলছেন, সচিনের যে জীবন্ত স্মৃতি তার উপর অত্যাচার করা হচ্ছে। কেউ কেউ যেমন বলছেন, “সুরকার শান্তনু মৈত্রর একটা গান দিয়ে আমরা সচিনকে ভাবতাম। সচিন যখন বিদায় নেবেন, তখন থ্রি ইডিয়টসের গানটা বারবার মনে পড়বে। ‘বেহতি হাওয়া সা থা ও...উড়তি পতঙ্গ সা থা ও...কঁহা গ্যয়া উসে ঢুন্ডো।” কাছাকাছি ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়: ও ছিল চলমান হাওয়ার মতো। ও ছিল উড়ন্ত ঘুড়ির মতো। আজ কোথায় চলে গেল। মানুষটাকে খোঁজো।
এঁদের আশঙ্কা সচিন নিজে রোম্যান্টিসিজম গায়ে মাখতে গিয়ে না তাঁকে ঘিরে রোম্যান্টিসিজমটা শেষ হয়ে যায়! |