ইতালির দুই নৌসেনাকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিত সময়সীমার মধ্যেই দেশে ফিরাইতে পারিয়া ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক পুলকিত বোধ করিলে তাহাকে দোষ দেওয়া চলে না। একটি বড় রকমের কূটনৈতিক সঙ্কট কাটিয়াছে, যাহার অন্য পরিণতি কেবল ইতালি ও ভারতের সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলিত না, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের পক্ষে নেতিবাচক সঙ্কেত পাঠাইত। ইতালির ভাবমূর্তিও সে ক্ষেত্রে কলঙ্কিত হইত বটে, কিন্তু রোমের মর্যাদা পুড়িয়াছে বলিয়া দিল্লীশ্বরদের বাঁশি বাজাইবার কোনও কারণ ঘটিত না নিশ্চয়ই। ইতালির সরকারকে তাহার ঘোষিত অবস্থান দ্রুত পালটাইয়া নৌসেনাদের ভারতে ফেরত পাঠাইতে সম্মত করিবার জন্য ভারতকে সরকারি ভাবে যে ধরনের আশ্বাস দিতে হইয়াছে, তাহাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক বলিয়া দাবি করা শক্ত, ‘মৃত্যুদণ্ডের কোনও প্রশ্নই এ ক্ষেত্রে ওঠে না’ এই ‘ক্ল্যারিফিকেশন’ দিতে না হইলেই নিশ্চয়ই সলমন খুরশিদরা খুশি হইতেন। এমন ‘অগ্রিম আশ্বাস’ আদালতের এক্তিয়ারের উপর ছায়া ফেলে কি না, সেই প্রশ্ন উঠিয়াছে, ওঠা অনিবার্য ছিল। কিন্তু সর্বনাশ সমুৎপন্ন হইলে অর্ধেক রক্ষার্থে অর্ধেক ত্যাগ করাই বিধেয়, এই সহজ সত্যটি বুঝিবার জন্য পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রতিপক্ষের সহনসীমাটি না জানিলে কূটনীতির স্নায়ুযুদ্ধে বিজয়ী হওয়া শক্ত। ইতালি সরকার ন্যূনতম কিছু আশ্বাস না পাইলে নৌসেনা দুই জনকে ভারতে পাঠাইতে পারিত না, কারণ তাহাকেও স্বদেশের জনমত শুনিয়া চলিতে হয়। রোমের সহনসীমা বুঝিয়া দিল্লি অর্ধেক পরিত্যাগ করিয়াছে। বাস্তববাদী কূটনীতি অলীক আত্মগরিমা দিতে পারে না, কার্যকর স্বস্তি দিতে পারে।
কিন্তু স্বস্তি আর শ্লাঘা এক নহে। দিল্লির শ্লাঘাবোধের কোনও কারণ নাই। পরিস্থিতি এমন সঙ্কটে পরিণত হইতে দেওয়াই উচিত হয় নাই। গুলিচালনায় দুই ব্যক্তির মৃত্যু ঘটিবার পরে যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টির নিষ্পত্তি জরুরি ছিল। সেই নিষ্পত্তি আদালতের বাহিরে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ঘটিতে পারিত, আবার আদালতে যাওয়া সাব্যস্ত হইলে বিচারপ্রক্রিয়া যথাসম্ভব দ্রুত সম্পন্ন হওয়া উচিত ছিল। এবং গোটা ঘটনাপরম্পরায় দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে আরও অনেক বেশি বোঝাপড়া জরুরি ছিল। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই কেবল দক্ষ কূটনীতি দেখা যাইবে, স্বাভাবিক অবস্থায় গয়ংগচ্ছ ইহা আগুন নিভাইবার সামর্থ্যের প্রমাণ হইতে পারে, সুশাসনের লক্ষণ নহে। ‘দ্রুত বিচার’-এর আশ্বাস সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রথমত, সব বিচারই দ্রুত হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, এই মামলার বিচারের জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ আদালত গঠনের নির্দেশ দিয়াছিল গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে, এখন নূতন করিয়া বিশেষ আদালতের আশ্বাস দিতে হইতেছে ইহা নিশ্চয়ই ভারতীয় প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থার গৌরব বৃদ্ধি করে না। অভিযুক্ত ব্যক্তি শ্বেতাঙ্গ হইলেই এ দেশে ‘দেশপ্রেম’-এর জিগির ওঠে। সেই প্রাচীন অভ্যাসের উত্তরাধিকার ছাড়িয়া স্বদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উন্নতিসাধনে যত্নবান হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। |