মধুবংশীর গলি নামক দীর্ঘ কবিতায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র লিখিয়াছিলেন, ‘কে শত্রু ঠিক নেই, নিজেরাই মারামারি করছি, ঘরে বাইরে মরছি’। পঞ্চায়েত নির্বাচন লইয়া রাজ্য সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সংঘাত যে স্তরে পৌঁছাইয়াছে, তাহা ঘরে ও বাহিরে পশ্চিমবঙ্গের ভূলুণ্ঠিত মানসম্মানকে পাতালে প্রবেশ করাইতে পারে। এবং, এই পরিস্থিতির ষোলো আনা দায় রাজ্য সরকারের। তাহারা বিভিন্ন প্রশ্নে অনধিকার চর্চা করিতে গিয়া এই সম্পূর্ণ অনাবশ্যক জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছে। প্রথমত, কতগুলি পর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে বা কোন পর্বে কোথায় ভোট হইবে, তাহা সম্পূর্ণতই কমিশনের বিচার্য হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, রাজ্য প্রশাসন কত পুলিশ দিতে পারে তাহা সরকার বলিবে, কিন্তু তাহা যথেষ্ট কি না, সেই বিষয়ে বিচার করিবে কমিশন, এবং সেই অনুসারেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা ও পরিমাণ নির্ধারিত হইবে। তৃতীয়ত, নির্বাচন পরিচালনার কাজ তদারকি করিবার জন্য কোন স্তরের সরকারি আধিকারিক উপযুক্ত, তাহার নীতি নির্ধারণ কমিশনের কাজ। সরকারি কর্তাদের ব্যক্তিগত জেদের কারণেই হোক, দলগত অভিসন্ধির বশেই হোক বা অন্য কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন এই প্রত্যেকটি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়া চলিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী কি সত্যই মনে করেন, তাঁহার নব্বই শতাংশ (হয়তো এত দিনে নিরানব্বই) কাজ শেষ, সুতরাং এখন ঈষৎ ‘যুদ্ধু যুদ্ধু’ খেলা করা যাইতে পারে!
মূল প্রশ্নটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালনার যথাযথ পদ্ধতি লইয়াই। লক্ষণীয়, পঞ্চায়েত বা পুরসভার নির্বাচন অতীতে নির্বাচন কমিশনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইত না। স্থানীয় স্বশাসিত সংস্থাগুলির নির্বাচনও নির্বাচন কমিশনের আওতায় আসিয়াছে পরে, নব্বইয়ের দশকে। অতঃপর স্বশাসিত সংস্থাগুলির ভোট-প্রক্রিয়ার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণও কমিশনেরই হস্তগত হইয়াছে। এক্তিয়ার লইয়া দ্বন্দ্বে তথাপি বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচিত সরকারের সহিত কমিশনের বিরোধ বাধিয়াছে। কোনও কোনও বিরোধ মীমাংসার জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সংবিধান বেঞ্চ অবধিও পৌঁছায়। গুজরাতের আমদাবাদ মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের নির্বাচন উপলক্ষে এমনই এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ২০০৬ সালে যে রায় দেয়, তাহাই এক্তিয়ারের প্রশ্নে এখনও শেষ কথা। সংবিধান বেঞ্চের অভিমত: রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও এক্তিয়ার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনেরই অনুরূপ। সরকার এই কমিশনকে নিযুক্ত করিতে পারে, করিয়া থাকেও। কিন্তু এক বার নিয়োগ করার পর কমিশনের কাজকর্মে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না, কমিশন সরকার হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভাবে কাজ করার অধিকারী। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় পঞ্চায়েত বা পুরসভার ভোটপর্ব পরিচালনায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সার্বভৌম ক্ষমতার দিকেই ইঙ্গিত করে। এই প্রেক্ষিতে কমিশনের কেবল সরকারকে ‘পরামর্শ দিবার অধিকার আছে, নির্দেশ দিবার নয়’ এমন দাবি অজ্ঞতাপ্রসূত। ভূতপূর্ব সরকার যে আইনই বিধানসভায় অনুমোদন করাইয়া থাকুক, সুপ্রিম কোর্টের সংবিধান বেঞ্চের অভিমতের সামনে তাহা টিকিবেই, এমন কোনও নিশ্চয়তা নাই।
ইহা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের সুষ্ঠু পরিচালনার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন পরিচালনায় তাহার স্বাধীনতা না থাকিলে সেই গুরুত্বের বিশেষ অমর্যাদা ঘটে। প্রথমত, আইনে তাহার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনের নৈতিক কর্তব্য তাহাকে স্বাধীন ভাবে কাজ করিতে দেওয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণতান্ত্রিক চেতনা যদি তাঁহার আত্মসচেতনতা অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক হয়, তবে তিনি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করুন। তাঁহার সরকার বিবিধ প্রসঙ্গে পূর্বসূরির মুণ্ডপাত করিলেও এই বিষয়ে তাহার তৈয়ারি করা আইনটির সুযোগ লইতে তৎপর। অথচ, প্রকৃত পরিবর্তন চাহিলে তাঁহার কাজ আইনটি সংশোধন করিয়া পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে সমর্পণের ব্যবস্থা করা, অর্থাৎ রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় কমিশনের সমকক্ষ করিয়া তোলা। তাহাই হইবে গণতন্ত্রের পক্ষে ঐতিহাসিক উদ্যোগ। |