পথ দেখাচ্ছেন অন্যদেরও
ইচ্ছে-ডানার জোরে বাধার পাহাড় পেরোলেন তিনকন্যা
নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো রীতিমতো লড়াই করেই এই স্বপ্ন সার্থক করেছেন জলপাইগুড়ির তিন কন্যা। শুধু আত্ম-প্রতিষ্ঠা নয়, অন্য মেয়েদেরও অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছেন ওঁরা।
পাণ্ডাপাড়ার জবা শর্মা অত্যন্ত ব্যস্ত একজন নাট্যকর্মী। নিজের নাটকের দল ‘ইচ্ছে ডানা’ নিয়ে দেশে-বিদেশ চষে বেড়ান। মাত্র তিন বছরের মধ্যে এই নাটকের দল যথেষ্ট সাড়াও ফেলেছে। অথচ শুরুর দিনগুলো ছিল একেবারে অন্য রকম। স্কুলে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল জবার। আরও পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা-হারা মেয়েটির ইচ্ছে পরিবারে আমল পায়নি। শ্বশুরবাড়িতে গিয়েই নাটকের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয়। ক্রমে নাটককেই নিজের দুনিয়া বানিয়ে ফেলা। স্বামীর উৎসাহ ছিল। তবে নিত্য মহড়া দিতে যাওয়া, রাতে ফেরা, এ সব নিয়ে নানা শ্বশুরবাড়ি ও পাড়া-প্রতিবেশীর গঞ্জনা সইতে হয়েছে। তখন জবাদেবীরা বেলাকোবায় থাকতেন। পরে দুই ছেলের পড়াশোনার জন্য গ্রাম ছেড়ে জলপাইগুড়ি শহরের বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে আসেন। নাটকের দলে সর্বক্ষণের কর্মীর জায়গাটাও জুটে যায়। স্বপ্নপূরণ অবশ্য তখনও বহু দূর।
জবাদেবী জানালেন, ভাল ‘পার্ট’ জুটত না। টিকিট বিক্রি করে সময় কাটত। ছোট চরিত্রে ভাল অভিনয় করলেও পরের নাটকে মিলত নিতান্ত ফালতু চরিত্র। এ সব সইতে পারেননি। তাই নিজেই একটা নাটকের দল গড়ে তোলার কাজে নেমে পড়েন। একান্ত ভাবেই মেয়েদের নাটকের দল। ২০১০ সালে স্বপ্ন সার্থক হয়। তৈরি হয় জবা শর্মা পরিচালিত মেয়েদের নাটকের দল ‘ইচ্ছে ডানা’। পুরনো সে সব কথা বলতে বলতে আবেদপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন জবাদেবী। বললেন, “এখন বেশ লাগে। এক সময় গ্রামের যে সব লোক খারাপ কথা বলত, দেখা হলে এখন তারাঁই বলেন, খবরের কাগজে তোদের নাম-ছবি দেখলাম। এটাই তো চেয়েছিলাম।” জবাদেবীর দলে আশ্রয় খুঁজে লড়াই চালাচ্ছেন আরও অনেকে। যেমন, অনু রায়। স্বামী রিকশা টানেন। সংসারের জন্যই পরিচারিকার কাজ করতেন। সেই অনুই এই সে দিন ইলাহাদাবাদে নাটক করে এলেন।
জবাদেবীর মতোই লড়াইয়ের জীবন জলপাইগুড়ির দেশবন্ধুপাড়ার কবিতা সরকারের। তিনি এলাকার স্কুলছুট, দুঃস্থ পরিবারের মেয়েদের সেলাই দিদিমণি। সম্পূর্ণ নিখরচায় সেলাই শিখিয়ে বিভিন্ন মেলায় হাতের কাজ বিক্রির বন্দোবস্ত করে দেন কবিতাদেবী। এই মুহূর্তে ছাত্রী সংখ্যা ৫০ জন। কেন করেন এ সব? জবাবে নিজের গল্প শোনালেন কবিতাদেবী। বললেন, “সেটা ১৯৯২ সাল। ক্লাস টেনে পড়তে পড়তেই ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। তিনটে মেয়ে হল। কিছুদিন পরে স্বামীর সঙ্গে ডির্ভোসও হয়ে গেল। বাপের বাড়িতে চলে এলাম। নিজেকে সংসারের বোঝা করে তুলতে চাইনি। তাই সেলাইয়ের কাজে নেমে পড়ি। আমার মতো মেয়েরা যাতে স্বাবলম্বী হয়, সে জন্যই সেলাই শেখাই।” এই কাজ করেই বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। অন্য দুই মেয়ে স্কুলে পড়ছে। নিজেও দূরশিক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন। কম্পিউটারও শিখে নিয়েছেন।
রেসকোর্স পাড়ার ইন্দিরা দিদিমণিও জানেন সমাজে মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যেতে দরকার শিক্ষা। তাই তিস্তা পাড় হোক বা শহরের অন্য কোনও বস্তি, স্কুলে যায় না এমন মেয়ে দেখলেই নিয়ে আসেন জলপাইগুড়ি রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষিকা ইন্দিরা সেনগুপ্ত। নিজের স্কুলে তাঁদের লেখাপড়া শেখান। খাতা-বই কিনে দেওয়া থেকে ইউনিফর্ম বানানো, এমনকী টিফিনের দায়িত্বও ইন্দিরাদিরই। ২০০৭ সাল থেকে এই কাজ করছেন তিনি। সাফল্যও মিলছে। এখনও পর্যন্ত শ’খানেক মেয়েকে নিজের স্কুলে আনতে পেরেছেন ইন্দিরাদেবী। তাদের মধ্যে জনা চল্লিশেক উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়েছে। এদের স্নাতক করাই এখন ইন্দিরাদেবীর লক্ষ্য। তাঁর কথায়, “কোনও সমাজে যদি মেয়েরা শিক্ষায় পিছিয়ে থাকে, তবে সেই সমাজ বেশি দূর এগোতে পারে না। তাই নিজের নিজের সাধ্যমতো ওদের শেখাই-পড়াই। যাতে ওদের মধ্যে অধিকার আদায়ের বোধটা চাগিয়ে ওঠে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.