মিটারে অটো চালানোর চেষ্টায় মহানগরীর বিভিন্ন পরিবহণ বিভাগের কাছে সবিস্তার রিপোর্ট চাওয়া হল মহাকরণ থেকে। সংশ্লিষ্ট সরকারি আইনজীবীর সঙ্গেও কথা বললেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। কী ভাবে মিটারে অটো চালানো শুরু করা যায়, দফতর-কর্তাদের কাছে তা সবিস্তার জানতে চেয়েছেন তিনি। রবিবার মন্ত্রী বলেন, “দু’সপ্তাহের মধ্যে এই রিপোর্ট আমার হাতে আসবে। মিটারে অটো চালানোর ব্যাপারে হাইকোর্ট তিন মাস সময় দিয়েছে। আশা করি আমরা ইতিবাচক ব্যবস্থা নিতে পারব।” অন্য দিকে, অটোয় মিটার বসানোর ভাবনার প্রতিবাদে কর্মসূচি নিচ্ছে ট্যাক্সি-মালিকদের সংগঠন। আজ, সোমবার এ নিয়ে বৈঠক ডেকেছে মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন।
মিটার লাগানোর আগে আর একটি বিষয় সামনে এসেছে। তা হল অবৈধ অটোর সমস্যা। কারণ, মিটার দেওয়া হবে শুধু বৈধ অটোকেই। এ কথা জানিয়ে সরকারি আইনজীবী পন্টু দেবরায় বলেন, “স্বীকৃত অটোয় লাগানো হবে মিটার। কলকাতা এবং সংলগ্ন তিন জেলায় এ রকম অটোর সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো। অথচ চলে ৫০ হাজারেরও বেশি। এটা একটা বড় সমস্যা।” তাঁর বক্তব্য, বেআইনি অটোগুলি চলে মূলত শহরতলি অঞ্চলে। |
তৃণমূল কংগ্রেস-নিয়ন্ত্রিত অটোচালক সমিতির কোষাধ্যক্ষ অভিজিৎ দাসও স্বীকার করেছেন, বেআইনি অটোর সংখ্যা অজস্র। মিটার দেওয়া শুরু হলে সরকারি ছাঁকনিতে বেআইনি এই সব অটো আটকে যাওয়ার কথা। বেআইনি অটো চলছে কাদের মদতে? অভিজিৎবাবুর মতে, “যেখানে যে রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেশি, তাঁদের মদতে চলছে অবৈধ অটো।” ‘সিটু’-নিয়ন্ত্রিত ‘কলকাতা অটো অপারেটর্স ইউনিয়নের’ সাধারণ সম্পাদক বাবুন ঘোষও এ ব্যাপারে একমত। সমস্যা মেটানো যায় কী ভাবে? অভিজিৎবাবুর মতে, “সরকারকে কঠোর এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ করতে হবে।” তবে বাবুনবাবু বলেন, “মিটার লাগিয়ে কেবল বৈধ অটো চালানো বাস্তবে সম্ভব নয়।”
গত ৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে রাজ্য সরকার জানিয়েছিল, বাস-ট্রাম-ট্যাক্সির মতো অটোতেও সরকার ভাড়া বেঁধে দেবে। ওই দিন সরকারি আইনজীবী পন্টু দেবরায় এজলাসে বলেন, “কয়েক দিনের মধ্যে কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার অটো ভাড়া ঠিক করে ফেলতে সরকার সক্ষম।” তা হয়নি। গত ৩ জানুয়ারি কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র জানতে চান, দেশের অন্য শহরের মতো কেন এ শহরেও অটো মিটারে চলছে না। তিনি বলেন, “ট্যাক্সির সস্তা বিকল্প অটো মিটারে চলবে বলেই চালু হয়েছিল।” এর পরে শুক্রবার হাইকোর্ট জানায়, মিটার ছাড়া রাজ্যের কোথাও অটো চালানো যাবে না। অটোর ভাড়া ঠিক করে দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। অটোতে চালকের পাশে যাত্রী নেওয়া যাবে না। গন্তব্যের আগে কোনও জায়গায় যাত্রী তোলা বা নামানোও চলবে না। তিন মাসের মধ্যে এই সব নির্দেশ কার্যকর করে রাজ্য সরকারকে হাইকোর্টে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। অটো সংক্রান্ত দু’টি জনস্বার্থের মামলায় এই নির্দেশগুলি দেয় হাইকোর্ট।
মহাকরণ সূত্রের খবর, কলকাতার পিভিডি এবং হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার আরটিএ-র কাছে এ ব্যাপারে হিসেব চাওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি পরিবহণমন্ত্রী বলেন, “অটোর মিটার কারা তৈরি করে, চালকরা কোন পদ্ধতিতে তা কিনবেন, কী ভাবে এই ব্যবস্থা শুরু করা সম্ভব সবই খতিয়ে দেখছেন পদস্থ অফিসারেরা। ওঁদের রিপোর্ট পেলে মিটার লাগানোর ভাবনা শুরু হবে।”
তা হলে কী এখনকার মতো অটোর রুট আর থাকবে না? গোড়ায় যেমন ছিল, অর্থাৎ ট্যাক্সির মতোই হাত দেখিয়ে যাত্রীরা অটোয় উঠবেন? সেক্ষেত্রে যাত্রীদের অটোর চড়ার খরচ অনেক বেড়ে যাবে না? তৃণমূল কংগ্রেস-নিয়ন্ত্রিত অটোচালক ইউনিয়নের সভাপতি তথা বিধানসভায় শাসক দলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আসলে আমাদের মানসিকতার বদল করতে হবে।” তাঁর প্রশ্ন, দেশের অন্যান্য শহরে যদি মিটারে অটো চলতে পারে, কেন এ শহরে পারবে না? অন্য দিকে, ‘সিটু’-র বাবুনবাবু বলেন, “মিটারে অটো চালানো সম্ভব নয়।” কেন? তাঁর যুক্তি “বাস্তব পরিস্থিতি সে রকম নেই।”
এ শহরে অটো যখন মিটারে চলত, ট্যাক্সি-মালিকদের সংগঠন আদালতের দ্বারস্থ হয়। সে ক্ষেত্রে ‘বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের’ (বিটিএ) যুক্তি ছিল, তাঁদের ব্যবসা অটোর জন্য মার খাচ্ছে। এখন সরকার যখন মিটারে অটো চালানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে উদ্যোগী হয়েছেন, কী বলছে বিটিএ? সংস্থার সভাপতি বিমল গুহর বক্তব্য, “এমনিতেই ট্যাক্সি চরম সঙ্কটের মুখে। অটোকে কনট্রাক্ট ক্যারেজ করে দিলে তা খতম হয়ে যাবে।”
বেশ ক’বছর মিটারে অটো চালিয়েছেন অভিজিৎ দাস। তাঁর মতে, “সিপিএমের রাজনীতির হিসেবই সব ওলটপালট করে দিয়েছে।” তিরিশ বছর আগে কলকাতায় প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৭০০ অটোর লাইসেন্স দেওয়া হয়। প্রতিটিতে মিটার ছিল। আশির দশকের শেষ দিকে চালকেরা মিটারের বদলে রুটে যাত্রী নিতে শুরু করেন। অভিজিৎবাবু অটো চালাতে শুরু করেন ১৯৮৬ থেকে। তাঁর কথায়, “আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছেমতো রুট তৈরি শুরু হল। শুরু হল মর্জিমাফিক ভাড়া নেওয়া।” কেন? প্রবীণ চালকদের একাংশের মতে, এতে চালকেরা আর্থিক ভাবে উপকৃত হতে শুরু করলেন। তাঁদের একটা বড় অংশ লাল ঝান্ডার নীচে সঙ্গবদ্ধ হলেন। পরিবহণের এই ক্ষেত্রটার উপর মৌরসিপাট্টা জারি হল ওঁদের।
অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেননি সিটু নেতা রাহুল সান্যাল। ২৫ বছর ধরে অটো চালাচ্ছেন এ শহরে। তাঁর বক্তব্য, “মিটার তুলে দেওয়ায় চালকদের আয় কিছুটা বাড়লেও বেশি উপকৃত হয়েছিলেন যাত্রীরা।” তাঁর যুক্তি, গোড়ায় প্রচলিত ‘কলকাতা পারমিট’ থাকা অটো বেশ কিছু জায়গায় যেতে পারত না। ধীরে ধীরে চাহিদার জন্য এই সব বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে যায়। |