দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা এলাকার বাসিন্দা বছর সতেরোর শবনমের (নাম পরিবর্তিত) দু’বেলা খাওয়া জুটত না। সেটা ২০১০ সালের কথা। গ্রামে মাঝে-মধ্যে রাবেয়া নামে এক মহিলা আসতেন। অনেক মেয়েদের তিনি মুম্বই-পুণেতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রাবেয়ার কাছে চাকরি জুটিয়ে দেওয়ার আর্জি জানাল শবনম। রাবেয়া চাকরির নামে তাঁকে নিয়ে গিয়ে তোলেন পুণের যৌনপল্লিতে! কয়েক মাস পরে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শবনমকে উদ্ধার করে হোমে রাখে। কিন্তু ধরা পড়ার তিন মাসের মধ্যেই জামিন পেয়ে যান রাবেয়া। এখনও চার্জশিট দেয়নি পুলিশ।
দক্ষিণ ২৪ পরগনারই রামকৃষ্ণপুর গ্রামের আমিয়ার সঙ্গে বিয়েবাড়িতে পরিচয় হয়েছিল আমিরুদ্দিন গাজি-র। সেই থেকে সম্পর্ক। বিয়ের আগে সহবাসের ফলে মাত্র ১৪ বছর বয়সে গর্ভবতী হয়ে যায় আমিয়া। চাপে পড়ে আমিয়াকে বিয়ে করলেও সন্তান জন্মের পরে তাকে অস্বীকার করে আমিরুদ্দিন ও তার পরিবার। আমিয়া-র অভিযোগ, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার উপরে ভয়াবহ নির্যাতনও চালায়। ছেলেকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে যায় আমিয়া। খোরপোষের মামলা করে। সেই মামলা অত্যন্ত ধীর গতিতে এগোচ্ছে।
আমিয়া-শবনমদের মতো প্রায় ১৯-২০ জন মেয়ে গত সপ্তাহে ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস’ (এনইউজেএস)-এর এক আলোচনাসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। নারীদিবসের কথা মাথায় রেখে আয়োজিত এই সভায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের কিছু ব্যক্তিত্বকে নিয়ে তৈরি ফোরামের সামনে ওঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। সকলের কথাতেই ঘুরেফিরে আসে একটা অভিযোগ মামলার অগ্রগতিতে দেরি বা চার্জশিট দিতে দেরির কথা। নির্যাতিতাদের বক্তব্য, “এই দেরির জন্য লড়াইটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে আমাদের।”
এনইউজেএস-এর লিগাল সেলের প্রধান অনির্বাণ চক্রবর্তীও মানছেন, “নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলায় দেরিটাই বড় সমস্যা।” কেন এই হাল? আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ মনে করেন, উপযুক্ত সংখ্যক বিচারপতি না থাকা একটা বড় কারণ। বিচারপতির সংখ্যা না-বাড়ালে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট করেও দেরির সমস্যা মিটবে না। তিনি জানান, কলকাতা হাইকোর্টে যেখানে ৫৮ জন বিচারপতির থাকার কথা সেখানে কখনওই ৪০-৪২-এর বেশি বিচারপতি থাকেননি। “জেলার অবস্থা আরও খারাপ। নিম্ন আদালতে বিচারকের অভাব থাকলে মামলা ফাস্ট ট্র্যাকে পৌঁছতেও দেরি হবে।”
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রুমা পাল জানাচ্ছেন, নারী নির্যাতনের মামলায় দ্রুত নিষ্পত্তি ঘটাতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নাদিরা পাথেরিয়ার নেতৃত্বে একটি বিশেষ বেঞ্চ গঠিত হয়েছে। তবে রুমাদেবীরও বক্তব্য, “শুধু বেঞ্চ তৈরি হলেই
হবে না। মামলা দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে আইনজীবীদের আরও
আগ্রাসী হতে হবে। মামলার দেরির বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকেও আরও লিখতে হবে।”
কিন্তু পুলিস যদি চার্জশিট দিতেই দেরি করে? স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “একটি-দু’টি বিচ্ছিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে দেরি হতে পারে। কিন্তু রাজ্যের প্রত্যেকটি থানাকে আমরা সতর্ক করেছি, যাতে এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে কোনও রকম দেরি না-করা হয়।’’
নারী নির্যাতনের মামলায় দ্রুত অগ্রগতি ও চার্জশিট নিশ্চিত করতেই মহিলা থানা তৈরি হচ্ছে। মহিলা আদালত গঠিত হচ্ছে। বাসুদেববাবুর কথায়, “তবে সব ঠিক আছে এটা বলব না। আরও অনেক কিছু করতে হবে। জেলার থানাগুলিতে কাজের চাপ অনেক বেশি থাকে। তবুও নারী নির্যাতনের মামলায় দেরি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।” |