যুদ্ধে নেমে দ্বিধায় পড়লেই হেরে যাবে।
দুশো বছর আগে বলেছিলেন, লাতিন আমেরিকার মুক্তিসূর্য সাইমন বলিভার। যা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে মেক্সিকো, কোস্তারিকা থেকে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা। রবিবার কল্যাণীতে কোস্তারিকার দেপোর্তিভো সাপ্রিসা-র বিরুদ্ধে মোহনবাগান কোচ করিম বেঞ্চারিফার সে রকম দ্বিধাই কি কাজ করল ০-১ হারে! যদিও সবুজ-মেরুন কোচ সে কথা মানতে নারাজ। ম্যাচ শেষে বলে গেলেন, “বিশ্বমানের গোলে হেরে গেলাম।”
দু’দিন আগেই এই কল্যাণীতে ওডাফার করা পাঁচ গোলে জিতে রসিকতার সুরে করিম বলেছিলেন, “এ বার প্রথম এগারো বাছা কষ্টকর হবে।” কিন্তু আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে সেই রসিকতা যে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে তা কে জানত? কে-ই বা জানত, শুক্রবারের পাঁচ গোলের রাজা ওডাফাকে রবিবারেই ফকির বানিয়ে দেবেন এক দল অনূর্ধ্ব-২৩ এবং কয়েক জন পেনশন স্কিমে চলে যাওয়া কোস্তারিকান ফুটবলার। বিদেশি দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের ঔজ্জল্য যখন কয়েকদিন আগেও সেলাঙ্গরকে হারিয়ে স্বমিহমায়, তখন বিদেশি দল সামনে পড়তেই পুরনো ঐতিহ্য মেনে হঠাৎই ফিকে মোহনবাগান। |
সাপ্রিসা সম্পর্কে সে অর্থে কোনও ধারণা ছিল না মোহনবাগানের। শিল্ড সেমিফাইনালের টিকিট হাতে চলে আসায় এ দিন প্রথম দলে আইবরের পরিবর্তে নির্মল ছেত্রী এবং কুইনটনের বদলে জুয়েল রাজাকে রেখে ৪-৪-২ ছকে দল নামিয়েছিলেন মোহনবাগান কোচ। আক্রমণে ওডাফা-টোলগে।
উলটো দিকে, শনিবার রাতেই দুই বিশ্বকাপারকে পেয়ে যাওয়ায় সাপ্রিসার কোচ দল সাজিয়েছিলেন ৪-২-৩-১। খেলা শেষে কারণ হিসাবে বললেন, “কার্লোস হার্নান্ডেজ বলে দিয়েছিল ওডাফাই আসল লোক। ওকে ধরতেই এই ছক।” এমনিতেই ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে কোস্তারিকা (৫৩) ভারতের (১৬৭) থেকে বহু এগিয়ে। তাই সেই দেশের অনূর্ধ্ব-২৩ এবং ‘প্রবীণ’ ফুটবলারদের ফুটবলের ব্যাকরণটা যে ভাল মতোই রপ্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাসিং, অফ দ্য বল জায়গা নেওয়া, থার্ড ম্যান মুভসবেতেই জুয়েল, মণীশ ভার্গবদের ছাপিয়ে যাচ্ছিলেন সাপ্রিসার জোনাথন, ফ্লোরেসরা। একের পর এক পাসে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছিলেন বাগান রক্ষণকে। ফিনিশিংয়ের দুর্বলতায় একটার বেশি গোল হল না যা।
ওডাফার জন্য নব্বইয়ের ইতালি বিশ্বকাপে খেলা সাপ্রিসা কোচ ভালদিমির রেখেছিলেন ‘টাইট জোনাল মার্কিং’। বাগানের ‘কিং কোবরা’ বিপক্ষের পেনিট্রেটিভ জোনে বল ধরলেই তাঁকে ধরছিলেন ফেলিপে কিংবা সাপ্রিসা অধিনায়ক লুনা-র মধ্যে কেউ এক জন। প্রথম জনকে ওডাফা কাটিয়ে নিলে আসছিলেন দ্বিতীয় জন। আর তাঁকেও ওডাফা বোকা বানালে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন সাড়ে ছ’ফুটের লুইস হার্নান্ডেজ। ফলে জায়গা পাচ্ছিলেন না শেষ ছ’ম্যাচে ১৫ গোল করা নাইজিরিয়ান গোলমেশিন। তবুও তারই মধ্যে টোলগে বেশ কয়েক বার ফাঁকা পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ করতে পারেননি।
ভালদিমির গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর বাগানের আক্রমণ ভাগের এই হাঁসফাঁস অবস্থা দেখে নামিয়ে দিলেন কিশের স্পেন্সকে। ততক্ষণে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে স্নেহাশিসের পরিবর্ত নবি। ডান দিক দিয়ে এর পরেই উঠল কোস্তারিকার ‘বেগুনি দৈত্য’-দের আক্রমণের ঝড়। তা থামাতে গিয়েই ইচের ফাউল আর তার পরেই বিশ গজের দুরন্ত সোয়ার্ভিং ফ্রিকিকে গোল বিশ্বকাপার ওয়াল্টার সেন্তেনোর। বের্নাবৌতে রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে গোল রয়েছে তাঁর। কল্যাণীতে দর্শনীয় গোলের পর ম্যাচের সেরা সেন্তেনোই।
গোলের পরেও ২৪ মিনিট সময় পেয়েছিল মোহনবাগান। কিন্তু এই সময় গোলের মধ্যে থাকা সাবিথকে নামিয়ে কেন করিম ৪-৩-৩-এ গেলেন না তা বোঝা গেল না। বদলে নামালেন কুইনটনকে। কিন্তু তিনি পেন ওরজি নন যে, একক দক্ষতায় বিপক্ষ রক্ষণকে তুবড়ে দেবেন। কুইনটনের বাড়ানো বল পেয়ে ওডাফা সাপ্রিসা রক্ষণে হানা দিলেও হারিয়ে গেলেন পায়ের জঙ্গলে।
ম্যাচ হেরে গ্রুপে মোহনবাগানের পয়েন্ট দাঁড়াল ছয়। এক ম্যাচ কম খেলে সাপ্রিসা চার। ইউনাইটেড সিকিমকে সাপ্রিসা হারালেই সেমিফাইনালে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। যা শুনে এমন দিনেও করিম বলছেন, “আমাদের সঙ্গে খেলার আগে বিপক্ষও পাঁচ বার ভাববে।” |
ন’বছর আগে ফেডারেশন কাপ ফাইনালে প্রাণ গিয়েছিল ডেম্পোর ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়রের। রবিবার কল্যাণীতে সংঘর্ষে সংজ্ঞা হারানো দেপোর্তিভো সাপ্রিসার গোলকিপার ডগলাস এসপিনোজার বড় বিপদ হয়নি চিকিৎসক জওহরলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিকিৎসা, আয়োজকদের তৎপরতায়। ম্যাচের নব্বই মিনিটে মণীশ ভার্গব চলতি বলে পা চালালে তা লাগে সাপ্রিসা গোলকিপারের ঘাড়ে। এর পরেই সংজ্ঞা হারান তিনি। বিপদ বুঝে সাপ্রিসা অধিনায়ক এস্তেবান লুনা শুরু করে দেন সিপিআর। |
দু’মিনিট পরে ডগলাস চোখ খুললে নিকটবর্তী বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে পাঠান মাঠে হাজির আইএফএ-র দুই সহসচিব। এখন তিনি সল্টলেকের এক হাসপাতালে ভর্তি। এমআরআই হয়েছে। আপাতত তিনি বিপন্মুক্ত। সহসচিবরা তৎপরতা দেখালেও হাসপাতালে হাজির আইএফএ-র এক প্রাক্তন সহ-সচিবের কাছে পরিস্থিতি জানতে গেলে তিনি কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করেন সাংবাদিকদের। সাংগঠনিক ত্রুটির মধ্যে এই ধরনের ব্যক্তিদের উপস্থিতি শিল্ডের ঐতিহ্য আরও ফিকে করছে। |
মোহনবাগান: অরিন্দম, নির্মল, মেহরাজ, ইচে, স্নেহাশিস (নবি ২৬ মি., বিশ্বজিৎ ৬১ মি.) ডেনসন, মণীশ মৈথানি, জুয়েল, মণীশ ভার্গব, টোলগে (কুইনটন), ওডাফা।
|