কলিকাতার রাস্তায় অটো রিকশার দাপট প্রশ্নাতীত। সেই অটো রিকশার চালকদের দাপটও। ভারতের আর সমস্ত শহরে যখন অটো রিকশা মিটারে চলে, বামফ্রন্ট আমলের এক বিচিত্র কু-অভ্যাসের উত্তরাধিকার বহন করিয়া নগর কলিকাতার অটো রিকশাগুলো মিটারের ধার ধারে না। তাহারা ‘রুট’-এ চলে। কেন, তাহার উত্তর ইউনিয়নের নেতারা জানেন। কোন রুটে কত ভাড়া হইবে, তাহাও। সম্প্রতি কলিকাতা হাইকোর্ট আদেশ করিল, তিন মাসের মধ্যে রাজ্যের সর্বত্র অটো মিটারে চালাইতে হইবে। এক্ষণে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক: পশ্চিমবঙ্গ কি সভ্য জগতের মানচিত্রের বাহিরে অবস্থিত? নেতারা সম্ভবত এই প্রশ্নের মর্মার্থ অনুধাবন করিতে পারিবেন না। তবে, সভ্য জগৎ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা আছে, এমন ব্যক্তিমাত্রেই বুঝিবেন, সেইখানে কোনও আদালতকে এই জাতীয় আদেশ করিতে হয় না। রাজ্যের সমস্ত রাস্তা জুড়িয়া এতখানি বে-আইন রমরম করিয়া চলিতে পারে, এই কথাটি সভ্য জগতে অকল্পনীয়। বস্তুত, কলিকাতায় যে ভাবে অটো রিকশা চলে, তাহা ভারতের আর কোনও বড় শহরে চলে না। সর্বত্রই অটো রিকশা মিটারে চলে। শত প্রলোভনেও চালকরা অটোর সামনের আসনে যাত্রী বসান না। তাঁহারা জানেন, সেই বেনিয়ম প্রশাসন বরদাস্ত করিবে না। পশ্চিমবঙ্গ অন্য দুনিয়া। এখানে অটো রিকশাচালকরা বিলক্ষণ জানেন, তাঁহাদের শত বেয়াদবি মাফ, কারণ তাঁহারা প্রয়োজনে পতাকা হাতে পথে নামিবেন। কথাটি ‘পরিবর্তন’-এর আগে যেমন সত্য ছিল, পরেও ততখানিই সত্য। সেই কারণেই আদালতকে এমন আদেশ জারি করিতে হয়। আদশটি কার্যকর হইলে শহরবাসী স্বস্তির শ্বাস লইবেন।
তবে, আদেশটি শেষ পর্যন্ত কার্যকর হইবে, শহরের রাস্তায় রুটের অটোর দাপট কমিবে, এমন আশা করিতে ভরসা হয় না। তাহার কারণ, রাজনীতির পায়ে নাগরিক স্বার্থকে বলি দেওয়ার অভ্যাসটি এই রাজ্যের নেতাদের মজ্জাগত। মোটর ভেহিক্লস আইনে স্পষ্ট বলা আছে, মিটার ব্যতীত অটো রিকশা চালানো যাইবে না। ১৯৮৯ সালের সংশোধনীতেও একই কথা বলা হইয়াছে। তাহার পরেও বেনিয়মটি দিব্য চলিতেছে, কারণ এই বে-আইনি অটো রিকশার সহিত যাঁহাদের স্বার্থ জড়িত, তাঁহারা রাজনীতিকদের নিকট অপরিহার্য। ফলে, অটোর সামনে যথেচ্ছ যাত্রী বসানোই হউক অথবা ইউনিয়নের মর্জিতে ভাড়া স্থির করাই হউক আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অথবা কালীঘাট, কোনও ক্ষমতার কেন্দ্র হইতেই বাধা আসে নাই। টু-স্ট্রোক অটো রিকশা বন্ধ করিবার ক্ষেত্রেও প্রশাসনিক গাফিলতি দেখিবার মতো ছিল। এখন সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি ঢালিয়া সাজা ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। এখনও বহু বে-আইনি অটো রিকশা চলিতেছে। সেগুলিকে বাছিয়া বাদ দিতে হইবে। অবিলম্বে মিটারে অটো চালাইবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। এই শহর বা এই রাজ্যের রাস্তাগুলি যে বে-আইনি অটোর অভয়ারণ্য নহে, সেই কথাটি প্রতিষ্ঠা করিবার সময় আসিয়াছে। কিন্তু তাহার জন্য নেতাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে। তাঁহারা পারিবেন কি? অভ্যাস বড় বিষম বস্তু। |