হুগলি জেলার ত্রিবেণী একটি পুণ্যস্থান। বহু পর্যটক আসেন, প্রচুর পুণ্যার্থী গঙ্গাস্নানে আসেন এবং রোজ ৬০/৭০টি শবদেহ নানা স্থান থেকে ত্রিবেণী শ্মশানে দাহ করতে আনা হয়। প্রচুর ছেলেমেয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করে। লরি, বাস, মিনি, স্কুলবাস, মোটর, মোটরভ্যান, অটো, রিকশা, মোটর-সাইকেল, সাইকেল ইত্যাদি অহরহ চলছে। তাই রাস্তায় সবর্দা যানজট। দু’ধারে বাজার বসে রাস্তা আরও সংকীর্ণ হয়েছে।
এ হেন রাস্তায় ব্যান্ডেল-কাটোয়া শাখার ত্রিবেণী রেলগেট পড়লে কী অবস্থা হয়, তা চাক্ষুষ করলে শিউরে উঠতে হয়। অসুস্থ ও বয়স্করা তো রাস্তায় হাঁটতেই পারেন না। বেরোতেই ভয় পান। |
বিপজ্জনক পথ: ত্রিবেণী। ছবি: তাপস ঘোষ |
ত্রিবেণীর রাস্তায় দমকলের গাড়ি চলাচল দুরূহ। যে কোনও বাড়িতে বা দোকানে আগুন লাগলে ওই গাড়ি পৌঁছবার আগেই বহু বাড়ি ও দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। স্কুলবাস যেতে দেরি হয়ে যায়। ট্রেনযাত্রী ত্রিবেণী স্টেশনে পৌঁছবার আগেই ট্রেন ছেড়ে চলে যায়। স্কুলের ছেলেমেয়েরা স্কুলে পৌঁছবার আগেই স্কুল আরম্ভ হয়ে যায়। এই অঞ্চল আর কত দিন অবহেলিত থাকবে? কয়েকটি প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে:
১) ত্রিবেণী স্টেশন বাজার: স্টেশনের পাশেই রাস্তার দু’ধারে যে ভাবে বাজার বসে, দ্রুত ট্রেন ধরতে প্রাণ হাতে করে যেতে হয়। এটি পুরনো বাজারে সরাতে হবে।
২) পুরনো বাজার: প্রায় ২০-৩০ কাঠা জায়গা শেড সমেত ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে বহুতল বাজার করতে হবে। নীচে পার্কিং থাকবে। সুপার মার্কেট ফাঁকা পড়ে আছে, ওখানে বাজার বসাতে হবে।
৩) পোস্ট অফিস ও লাইব্রেরি: পুরনো ভাঙা বাড়ি ছেড়ে, নির্দিষ্ট স্থানে নতুন করে তৈরি করতে হবে।
৪) বাস স্ট্যান্ড: সমস্ত বড় ও ছোট তিনচাকা ও চারচাকা গাড়ি, সমস্ত অটো এক জায়গায় থাকবে এবং ওখান থেকেই ছাড়বে।
৫) রিকশা স্ট্যান্ড: সমস্ত রিকশা সিনেমাহল, ভাঙা ঘাট, মনসাতলা এবং স্টেশনের পাশ থেকে ছাড়বে।
৬) উড়ালপুল: ত্রিবেণী রেলগেটের উপর উড়ালপুল করলে যানবাহন চলাচলের বিশেষ সুবিধা হবে। উড়ালপুল হলে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছনো যাবে।
ভূপেন্দ্রনাথ ঘোষ। ত্রিবেণী, চন্দ্রহাটি, হুগলি
|
ওকাম্পো ভিলা ‘কবিতীর্থ’ নয়? |
জানুয়ারি ২০১২, আমরা বুয়েনস আইরেসে যাই (‘রবীন্দ্রনাথের চশমা চাদর আসছে...’/১৩-২)। কবিতীর্থ ওকাম্পো ভিলায় যাওয়ার বাসনায় অন্তর্জাল থেকে ঠিকানা জোগাড় হল: Villa Ocampo, Elortundo 1837, Beccar, B A. Argentina. এটা San Isictro এবং Victoria স্টেশনের মাঝখানে। Retiro স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে Beccar পৌঁছালাম। জিজ্ঞেস করে রেললাইন পার হয়ে নির্জন পথে Uriburu এবং Elortundo সংযোগস্থলের ডাইনে আরও একান্তে স্থিত এক সুবিশাল প্রাসাদের সামনে এলাম। ফলকে লেখা, Villa Ocampo, Escenario de culture, Unesco. এক-এক জনের Bono Coutribueion ১৮ পেসো। বিশাল জায়গা নিয়ে গথিক স্থাপত্যের ভিলা। গ্র্যাভেল বিছানো পথ। সব কিছু মধুগন্ধে ভরা। মনের গভীরে রবীন্দ্রসংগীতের অনুরণন। ভিলার ভিতরে সুপরিশীলিত গাইড একটা বিশাল পট দেখিয়ে বললেন, এটা ভিক্টোরিয়ার বাবা ইমানুয়েল ওকাম্পোর। গাইড ইংরেজিতে বলে চলেছেন, Victoria was a rebel. She was the lynchpin of intellectual circle of Buenos Aires. বিয়ের রাতেই নাকি স্বামীগৃহ ছেড়ে আসেন। ১৯২৪। মেক্সিকো যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ জাহাজে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সঙ্গী এলম্হার্স্ট। খবর পেয়ে আগে কখনও সাক্ষাৎ না-হওয়া অসুস্থ কবিকে ভিক্টোরিয়া নিয়ে আসেন। কবি কোনখানে থাকতেন? জানতে চাওয়ায় বিষণ্ণ হাসি হেসে গাইড বললেন, এ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ কখনও থাকেননি। ভিক্টোরিয়ার বাবা অপরিচিত, অজ্ঞাত, বিধর্মী, বিজাতীয় exotic (এই শব্দটি গাইড ব্যবহার করেছিলেন) বিদেশিকে তাঁর বাড়িতে থাকার অনুমতি দেননি। দমে না-গিয়ে ভিক্টোরিয়া তাঁর সমস্ত গহনা বিক্রি করে এখান থেকে ৩ ব্লক দূরে এক ভাড়াবাড়িতে কবির থাকার ব্যবস্থা করেন। সে বাড়ি এখন বন্ধ। আমরা যাকে বলে gobsmacked. গাইড বললেন, তবে, বিকেলের দিকে প্রায়ই কবি এ বাড়িতে আসতেন এবং লনে পাম গাছের তলায় বসে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপচারিতা চলত। সন্ধ্যায় ফিরে যেতেন। সেই গাছটি আজও সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। একটা টেবিলের ওপর কয়েকটি ফটো। তার মধ্যে একটি রবীন্দ্রনাথের। সঙ্গে কৃষ্ণমূর্তি, কামু, আঁদ্রে মালরো, গ্রাহাম গ্রিন, করবুসিয়ে প্রমুখ যাঁরা এ ভিলায় এসেছেন। ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধীর একটা ছবি আছে দেওয়ালে। গাইড স্প্যানিশে লেখা কবির প্রতি ভিক্টোরিয়ার শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ একটি বইয়ে San Isidro-র বাড়ির সামনে রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি দেখাল। এ ছাড়া এখানে কবির কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই। ভিক্টোরিয়ার সান্নিধ্যে কবির প্যাশনের যে প্রজ্জ্বলন ঘটে, তা ভিন্ন পথে পটুয়া কবির ছবিতে আদিম প্রসঙ্গহীন ভাষার মগ্নচৈতন্য থেকে উত্থিত।
সে দিন আমরা বিষণ্ণ হৃদয়ে ফিরে এসেছি। পরে একদিন Recoleta Cemetery-তে গিয়ে ভিক্টোরিয়ার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাই।
বিমান রায়। কলকাতা-৫৫ |