|
|
|
|
 |
ধর্মঘটের ধার কমেছে,
মানছে সিটুরই রিপোর্ট সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
|
সাধের ধর্মঘট-অস্ত্রে যে মরচে পড়ছে, প্রকারান্তরে এ বার মানতে বাধ্য হল সিটু।
অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পরপর দু’বছরে দু’বার দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটে সামিল হয়েছিল সিটু। তার মধ্যে এ বছর ২০-২১ ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘট ছিল টানা দু’দিনের। কিন্তু দু’বারের ধর্মঘটে অংশগ্রহণেই ‘গুরুতর দুর্বলতা’ দেখা গিয়েছে বলে মেনে নেওয়া হয়েছে সিপিএমের শ্রমিক সংগঠনের আসন্ন সর্বভারতীয় সম্মেলনের দলিলে। মধ্যবিত্ত এবং ভাল বেতনের কর্মচারীদের একাংশের মধ্যেই ধর্মঘটে যোগ দিতে অনীহা বেশি বলে সিটু নেতৃত্ব চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তার জন্য মূলত দোষারোপ করা হয়েছে সংগঠনের নেতৃত্বের ব্যর্থতার দিকেই। পশ্চিমবঙ্গের মতো যে রাজ্যে সংগঠন শক্তিশালী, সেখানে এমন ‘দুর্বলতা’ আরও বেশি উদ্বেগজনক এমন পর্যবেক্ষণও এসেছে সিটুর রিপোর্টে।
ধর্মঘট করে যে কোনও ফায়দা হচ্ছে না, সরাসরি এমন উপলব্ধিতে পৌঁছনোর জায়গায় এখনও যায়নি সিপিএম বা সিটু। তবে দলেরই একাংশের মতে, দু’বছরে দু’বার ধর্মঘটের জন্য কোমর বেঁধে আসরে নেমেও প্রত্যাশিত ফল না-পাওয়ার কথা যে ভাবে সিটুর সম্মেলনে দলিলে উঠে আসছে, সেটাও মন্দের ভাল! নিজেদের দুর্বলতা ফের প্রকট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেও যদি সিটু নেতৃত্ব ভবিষ্যতে ধর্মঘট ডাকার ক্ষেত্রে সংযম অভ্যাস করতে পারেন, তা হলে জনমানসে ইতিবাচক বার্তা যেতে পারে বলে ওই অংশের মত।
ফেব্রুয়ারিতে ৪৮ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘট নিয়ে তীব্র বিতর্ক বেধেছিল সিপিএমে। ভাষা দিবসের উপলক্ষকে ব্যবহার করে দ্বিতীয় দিন ধর্মঘট করার শিথিল করার পক্ষে সরব হয়েছিলেন এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দলের রাজ্য কমিটিতেও দু’দিনের ধর্মঘট নিয়ে প্রবল প্রশ্ন উঠেছিল। সিটুর পরিবহণ ইউনিয়নের নেতারাও সংগঠনের অন্দরে জানিয়ে দিয়েছিলেন, পরপর দু’দিন গাড়ি বন্ধ রেখে মজুরি হারাতে তাঁরা রাজি নন। এই সম্মিলিত চাপের মুখে সিটুর রাজ্য নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত ২১ ফেব্রুয়ারি রাজ্যে পরিবহণে ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। যার জেরে দ্বিতীয় দিন পশ্চিমবঙ্গে ধর্মঘটের দৃশ্যত কোনও প্রভাবই পড়েনি। এই ঘটনার পরে সিটুর অন্দরে দলেরই একাংশের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। সর্বভারতীয় সম্মেলনের জন্য সিটুর সাধারণ সম্পাদক তপন সেনের তৈরি-করা খসড়া প্রতিবেদনে অবশ্য সরাসরি সিপিএম নেতৃত্বের কোনও অংশের দিকে আঙুল তোলা হয়নি। শ্রমিক সংগঠনেরই কিছু রাজ্য কমিটি কাঙ্খিত ভূমিকা পালন করেনি, বলা হয়েছে সে কথাই। তবে সিটু সূত্রের খবর, এই প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই এপ্রিলে আসন্ন সম্মেলনে ধর্মঘট নিয়ে জোর বিতর্কের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে।
কেরলের কান্নুরে আগামী ৪ থেকে ৮ এপ্রিল বসছে সিটুর চতুর্দশ সর্বভারতীয় সম্মেলন। তারই খসড়া প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে: ‘অন্তত সর্বশেষ দু’টো পর্যায়ে ধর্মঘটে অংশগ্রহণে গুরুতর দুর্বলতা দেখা গিয়েছে। আমাদের পক্ষে শক্তিশালী রাজ্যেও মধ্যবিত্ত এবং ভাল বেতনের কর্মচারী, শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে এই দুর্বলতা লক্ষ করা গিয়েছে। তবে এই একই অংশের কর্মচারীদের কাছ থেকে কিছু রাজ্যে ধর্মঘটে পূর্ণ সাড়া পাওয়া গিয়েছে। কিছু রাজ্যে এবং কিছু ক্ষেত্রেই এই দুর্বলতা ছিল। এবং যখন আমাদের শক্তিশালী রাজ্যে এমন দুর্বলতা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়, তখন তা অবশ্যই অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রয়োজন হয় বিশেষ সংশোধনমূলক ব্যবস্থার’। পশ্চিমবঙ্গে ধর্মঘট ব্যর্থ করার জন্য প্রশাসনিক চাপ, শাসক দলের অত্যাচার ছিল। এতদসত্ত্বেও বেসরকারি-সহ কিছু ক্ষেত্রে ভাল ধর্মঘট হয়েছে বলে উল্লেখ করেই প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে: ‘যাবতীয় ভীতি এবং প্ররোচনা সত্ত্বেও কয়লা শ্রমিকেরা যদি দু’দিন ধরে সুন্দর ভাবে ধর্মঘট করতে পারেন, তা হলে ওই এলাকার লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের একাংশ, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডে ইস্পাত কর্মীরা তা করতে পারলেন না কেন’?
বস্তুত, এই ব্যর্থতার জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের যে দোষ দেওয়া উচিত নয়, তা-ও বলেছে সিটু। প্রতিবেদনে ‘যৌথ সংগ্রাম’ শীর্ষক অধ্যায়েই বলা হয়েছে: ‘সম্ভবত সংশ্লিষ্ট এলাকায় আমাদের নেতৃত্বই আন্তরিক ভাবে প্রচার গড়ে তুলতে পারেননি। শ্রমিক-কর্মচারীদের একাংশের মধ্যে সুযোগসন্ধানী মনোভাব এবং বিভ্রান্তি কাটাতে পারেননি। গভীর আত্মানুসন্ধান দরকার। তবেই আশু সংশোধনের রাস্তা পাওয়া যাবে’। খসড়া রিপোর্টই আরও বলছে ‘আমাদের সব রাজ্য কমিটি এবং শিল্প ফেডারেশন শুধু আমাদের সব সদস্যের কাছে পৌঁছনোর এই সুযোগ সদ্ব্যবহার করতে পেরেছেন, তা-ও বলা যাবে না! সংগঠনের বাইরের মানুষের কাছে যাওয়া তো দূরের কথা! অথচ এ নিয়ে সিটু সেন্টার থেকে বারবার নিদের্শিকা ছিল’।
সংগঠনের রিপোর্ট অনুযায়ী, সিটুর সদস্যসংখ্যা এখন ৫০ লক্ষের কিছু বেশি। এ বারের সম্মেলন থেকে যা ৮০ লক্ষে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হবে। কিন্তু সদস্য বাড়িয়ে হ্রাসমান প্রভাব ধরে রাখা যাবে কি না, প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সিপিএমের অন্দরেই! |
|
|
 |
|
|